আহমেদ রাজু
ভিয়েতনামের একটি মন্দিরে রক্ষিত আছে ১১০০ বছর আগের শিবলিঙ্গ। সেটি নবম শতাব্দীতে তৈরি। হিন্দুধর্মীয় দেবতা শিবের উপাসনার জন্য তৈরি করা হয় মূলত শিবলিঙ্গ। কাঠ, পাথর কিংবা কংক্রিট দিয়ে সাধারণত তৈরি হয় এটি।
ভারতের প্রত্নতত্ববিদরা সবচেয়ে প্রাচীন শিবলিঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন। সেটি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সাল অর্থাৎ, ৫০০০ বছর পূর্বে তৈরি। কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরের এশিয়ান সিভিলাইজেশনস মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয় প্রাচীন শিবলিঙ্গটি।
শিবলিঙ্গের পূজা হিন্দুধর্মালম্বীদের মধ্যে ব্যাপক প্রচলিত। শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের উপস্থিতি প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো। এই রীতি সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণাও আছে।
শিবলিঙ্গ সম্পর্কে সাতটি তথ্য
১. শিবলিঙ্গের পূজা কেবল ভারত আর শ্রীলঙ্কায় সীমাবদ্ধ নয়। প্রাচীন রোমে ‘প্রায়াপাস’ নামে যে বিগ্রহের পূজা হতো, অনেকের মতে সেটিও শিবলিঙ্গই ছিলো। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষেও পাওয়া গেছে বেশ কিছু শিবলিঙ্গ।
২. শিবলিঙ্গে থাকে মোট তিনটি অংশ।
সবচেয়ে নিচের চারমুখি অংশটি থাকে মাটির নিচে। তার উপরের অংশটি আটমুখি, সেটি বেদিমূল হিসেবে কাজ করে। আর একেবারে উপরের অর্ধবৃত্তাকার অংশটি পূজিত হয়। এ অংশটির উচ্চতা এর পরিধির এক তৃতীয়াংশ। এই তিন অংশের সবচেয়ে নিচের অংশটি ব্রহ্মা, তার উপরের অংশটি বিষ্ণু ও একেবারে উপরের অংশটি শিবকে প্রতীকায়িত করে। বেদিমূলে একটি লম্বাকৃতি অংশ রাখা হয়, যা শিবলিঙ্গের মাথায় ঢালা জল বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই অংশের নাম গৌরীপট্ট, যা মূলত যোনিপ্রতীক।
৩. হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী শিবলিঙ্গ পূজার মধ্যে কোনও অশ্লীলতা নেই। শিবলিঙ্গ একইসঙ্গে শিবের সৃজনাত্মক ও ধ্বংসাত্মক রূপের প্রতীক। অনেকে একে পুরুষাঙ্গের পূজা হিসেবে ব্যাখ্যা করে অশ্লীলতা বলে মনে করেন, তা একেবারেই ভুল ব্যাখ্যা। তা ছাড়া, হিন্দুধর্মে শিবকে নিরাকার বলে মনে করা হয়। কাজেই তাঁর লিঙ্গ একেবারেই প্রতীকী।
৪. স্বামী বিবেকানন্দের ব্যাখ্যা—স্বামীজী ‘অথর্ববেদ’-এর শ্লোক উদ্ধৃত করে শিবলিঙ্গকে আদি ব্রহ্মের স্বরূপ বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর মতে, আদি ও অন্তহীন ব্রহ্মের প্রতীক হলো শিবলিঙ্গ।
৫. শিবলিঙ্গের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা—শিবলিঙ্গের দিকে তাকালে দেখা যাবে এর লম্বাকৃতি অংশটিতে পরপর তিনটি খাঁজ কাটা। বিজ্ঞানী নিলস বোরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই তিনটি খাঁজ আসলে অণুর তিনটি উপাদান— প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনের প্রতীক। এই তিনটি উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের গঠনের প্রতীক হলো শিবলিঙ্গ।
৬. শিবলিঙ্গের বৈদিক ব্যাখ্যা—শিবলিঙ্গ যেহেতু ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, সেহেতু শিবলিঙ্গ পূজা করার অর্থ—আদি শক্তির সঙ্গে চৈতন্যের মিলনকে স্মরণে রাখা। এই ‘মিলন’-এর অর্থ অবশ্য শারীরিক মিলন নয়, বরং এ এক অতিপ্রাকৃত মিলন। বলা প্রয়োজন—সংস্কৃত ভাষায় ‘লিঙ্গ’ শব্দটির অর্থ কিন্তু পুরুষাঙ্গ নয়, বরং চিহ্ন। নির্গুণ শক্তি যখন সগুণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা শুরু করে তখন লিঙ্গই হয়ে ওঠে সেই রূপান্তরের চিহ্ন।
৭. শিবলিঙ্গের গায়ে যে সাপটি থাকে, তা আসলে সুপ্ত চেতনার ও কুলকুণ্ডলিনীর প্রতীক। এই শক্তির জাগরণকে চিহ্নিত করে শিবলিঙ্গ।