ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে সেখানকার কর্মচারীদের সংঘর্ষের জেরে সেবা কার্যক্রম বন্ধ আছে শনিবারও।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, আজ শনিবার (৩১ মে)পর্যন্ত টানা চারদিন ধরে চক্ষু চিকিৎসায় দেশের প্রধান হাসপাতালটি বন্ধ আছে; ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। জরুরি সেবা বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই এসে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
হাসপাতালটির কর্মচারীরা বুধবার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করলে সকাল ১০টার পর তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় সেখানে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। এক পর্যায়ে সেদিন আহতদের সঙ্গে যোগ দেন বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা।
জুলাইয়ের আহতরা হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনেও হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছিলেন হাসপাতালের এক চিকিৎসক। এই ঘটনায় চিকিৎসক, কর্মচারীদের অনেকে আহত হয়েছেন বলেও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক চিকিৎসক জানে আলম জানিয়েছিলেন।
পরে দুপুরের দিকে সেনা সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বিকালের দিকে। চিকিৎসক, কর্মচারীদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে নিরাপত্তার দাবিতে সেদিন থেকেই হাসপাতালে আসা বন্ধ রেখেছেন চিকিৎসক, কর্মচারীরা।
শনিবার সকালে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা আসছেন। কিন্তু ফটক বন্ধ থাকায় ভেতরে যেতে পারছেন না তারা। বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছেন।
রাজবাড়ী থেকে সত্তরোর্ধ কালা চাঁনকে নিয়ে এসেছেন তার মেয়ে হালিমা বেগম। সঙ্গে হালিমার এক চাচা। হালিমা বলেন, রাত তিনটায় রাজবাড়ী থেকে রওনা হয়েছে সকাল নয়টায় হাসপাতালের সামনে এসেছেন। ফটক বন্ধ থাকায় বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন তারা।
“আমরা এর আগে গত শনিবার আসছিলাম। ডাক্তাররা বাবাকে দেখে কিছু পরীক্ষা করাতে দেয়, সেগুলোর দেখানোর জন্য আজকে ডেট দিয়েছিল। তিনজন মানুষ ঢাকা আসতেই গেছে ১৫শ টাকা, আবার যাইতেও ১৫শ টাকা লাগব। গরীব মানুষ, বারবার এত টাকা কোথায় পামু?”
ঢাকার ভাসানটেক এলাকার আবদুল্লাহ আল নোমান নামে আট বছরের এক শিশুর চোখে বরশি বিঁধেছে। শিশুটিকে নিয়ে রিকশায় করে হাসপাতালে এসেছিলেন তার স্বজনরা। তবে হাসপাতাল বন্ধ থাকায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চলে যান তারা।
শিশুটির বাবা আজহারুল ইসলাম বলেন, “ভাসানটেক বেনারশী প্লটের ঝিলে অন্য পোলাপানের সাথে মাছ ধরতে গেছিল। কেমনে জানি এই বরশি চউখখে আইটকা গ্যাছে। খোলার লাইগা হাসপাতালে নিয়া আসছি। এখন দেখি হাসপাতাল বন্ধ।”
চোখের ডাক্তার দেখাতে ময়মনসিংহ থেকে আসা শফিকুল ইসলাম বলেন, “আইসা শুনি কোনো একটা গণ্ডগোল হইছে, চারদিন যাবৎ হাসপাতাল বন্ধ। অনেক টাকা খরচ কইরা ডাক্তার দেখানোর জন্য আইছি, দেখাইতে পারছি না। গণ্ডোগোল করছে তারা কষ্ট করতেছি রোগীরা।”
নাটোরের নলডাঙ্গা থেকে আসা হাফিজুর রহমান বলেন, তার ১২ বছর বয়সী মেয়ের চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য তারিখ দেওয়া ছিল। এ কারণে শনিবার তারা এসে দেখেন হাসপাতাল বন্ধ।
“ডাক্তার নাই, আমার মেয়ের চিকিৎসা না হলে কিভাবে হবে। তার চোখের কোনো ক্ষতি হলে সেই দায় কে নেবে?”
শনিবার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সামনে এসেছেন ওই হাসপাতালের একজন নারী কর্মচারী। বাসা কাছাকাছি হওয়ায় প্রতিদিন সকালেই একবার এসে ঘুরে যান তিনি।
ওই নারী বলেন, বুধবার জুলাই যোদ্ধাদের হামলায় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ অনেকে আহত হয়েছেন। এ অবস্থায় হাসপাতালে নিরাপদ বোধ করছেন না তারা।
“সবার সঙ্গে আমিও সেদিন অবরুদ্ধ ছিলাম, আর্মি গিয়ে উদ্ধার করেছে। পুরো হাসপাতাল তারা নিজেদের মত করে চালাতে চায়। এদের জন্য আমরা কি না করেছি। তাদের অনেককে বিদেশ থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়েছে। এখন তারা স্যারকে জিম্মি করেছে সবাইকে বিদেশ যাওয়ার রেফারেল লিখে দিতে হবে। পুরো হাসপাতালটাকে তারা জিম্মি করে রেখেছে।”
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলমকে মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আকবর কামাল শনিবার বলেন, সেদিনের ঘটনায় চিকিৎসক, কর্মচারীদের সঙ্গে জুলাই যোদ্ধাদের কয়েকজনও আহত হয়েছেন। দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন তারা।
“জুলাইযোদ্ধারা হাসপাতালের আট থেকে ১০ জন কর্মচারীর একটি তালিকা দিয়েছে। তারা বলছে ওই কয়েকজন বাদে বাকীরা হাসপাতালে এসে সেবা দিতে কোনো বাধা নেই। আমরাও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি যে হাসপাতালটি বন্ধ থাকায় মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। একটা ভালো সমাধান হবে আশা করি।”
উন্নত চিকিৎসা বা পুনর্বাসনের বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ তুলে গত রবিবার চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চার জুলাইযোদ্ধা বিষপান করেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তারা সহযোদ্ধাদের নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালের পরিচালককে অবরুদ্ধ করেন।
প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে সেনাবাহিনীর সহায়তায় অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি পান হাসপাতাল পরিচালক। এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ গায়ে কেরোসিন-পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে পুলিশের ভাষ্য।
পরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং আহতদের আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনায় নিরাপত্তার দাবিতে বুধবার সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন করছিলেন হাসপাতাল কর্মচারীরা। এ অবস্থায় হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। পরে আহতদের সঙ্গে যোগ দেন বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা।
সাননিউজ/ইউকে