মঞ্জুরুল আলম পান্না:
ব্যাবসা-বাণিজ্যের কথা যেন ভুলেই গেছে রাষ্ট্রগুলো। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ব্যস্ত পুরো বিশ্ব ৷ কেবল স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরি পরিষেবা নিশ্চিত করতেই নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ৷ এক দেশ থেকে আরেক দেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। থমকে গেছে বিনোদন জগৎ, এমন কী ক্রীড়াঙ্গনও। স্থবির হয়ে পড়ছে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা। একে একে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে বিদেশিদের জন্য ভিসা কার্যক্রম। আকাশ পথে নেমে এসেছে বিপর্যয়। জনসমাগম এড়িয়ে মানুষও গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে যে যার মতো করে। তবে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ করোনাকে ঘিরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিলেও অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ভাইরাসটির ক্ষতির তুলনায় এর আতঙ্কটাই বিশ্বব্যবস্থার ভিত নড়িয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ গত ২২ ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের শেষ থেকে চলতি বছরে প্রথমে এক সাধারণ ইফ্লুয়েঞ্জাতে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যূ ঘটেছে ১২ হাজারেরও বেশি মানুষের। হাসপাতালে ভর্তিই হয় প্রায় ৩ লাখ মানুষ। অথচ শুক্রবার পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে দেশটিতে ৫০ জনের মৃত্যূ এবং আড়াই হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে না হতেই যুক্তরাষ্ট্রে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা।
২০০৩ সালের সার্স ভা্ইরাসে মারা যায় ৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। মৃত্যূর হার ছিল ১০ শতাংশ। এর পর ২০১২ সালে মার্স ভাইরাসে মৃত্যুর হার ছিল ৩৫ শতাংশ, আর ২০১৪ সালে ইবোলায় এমন মৃত্যূর হার ছিল প্রায় ৫০ ষতাংশ। অথচ বর্তমান করোনা ভাইরাসে মৃত্যূর হার এখন পর্যন্ত গড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
কিন্তু সার্স, মার্স ও ইবোলার ক্ষেত্রে যতোটা না আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল তার চেয়ে হাজার গুণ আতংক সৃষ্টি করা হয়েছে করোনার ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানিয়েছেন, চীনের করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এতে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং পর্যটন খাতেও প্রভাব পড়ছে।
অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকস তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, করোনা ভাইরাস এশিয়ার বাইরে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি (১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন) ডলারের, যা বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কেউ কেউ বলছে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর সর্বনিম্ন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে এ বছর।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি’র পূর্বাভাস দিয়েছে, করোনা ভাইরাস সবচেয়ে খারাপ দিকে গেলে বাংলাদেশ ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতি কর্ম সংস্এথান হারাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ।
করোনা আতঙ্কে বিশ্বব্যাপি পর্যটন, বেসামরিক বিমান চলাচল থেকে শুরু করে অর্থনীতির খাতগুলো এরই মধ্যে পড়ছে মন্দার কবলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির উপর এমন অনিশ্চয়তার প্রকৃত মাত্রা সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না৷ টালমাটাল পুঁজিবাজারের পাশাপাশি কমে চলেছে তেলের দাম।বিশ্বজুড়ে ব্যাপক মন্দার আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে৷
বেশ কিছুদিন ধরেই করোনা ভাইরাস আতঙ্কে ধস চলছে বিশ্ব পুঁজিবাজারে। এখন সেটি ভূমিধসে রূপ নিয়েছে। কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের প্রভাবে দরপতনের একের পর এক রেকর্ড ভাঙছে পশ্চিমা পুঁজিবাজার। ৩৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দার সময়ও এতটা দর হারায়নি মার্কিন পুঁজিবাজার। শুক্রবার যুক্তরাজ্যের পুঁজিবাজারগুলোর সূচক কমেছে ১০ শতাংশ, যা ১৯৮৭ সালের পর সর্বনিম্ন।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক আর্থিক ব্যবস্থায় অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির পরেও দেশটির পুঁজিবাজারগুলো ছিল নিম্নমুখী। অস্বাভাবিক পতনের মুখে লেনদেন কিছুক্ষণ বন্ধ রেখেও ঠেকানো যায়নি ধ্বস। ফ্রান্স এবং জার্মানিতে শেয়ারের ১২ শতাংশেরও বেশি দরপতন ঘটেছে। বড় পতন হয়েছে জাপান, হংকং, অস্ট্রেলিয়ার শেয়ারবাজারেও।
আগে থেকেই নিম্নমুখী রয়েছে এশিয়ার পুঁজিবাজারগুলো। বৃহস্পতিবার ভারতের বাজারে যা হয়েছে, তা আগে কখনও হয়নি আর। সেনসেক্স এবং নিফটির এতো বড় পতনের নজির দেশটির শেয়ারবাজারের ইতিহাসে নেই। সেনসেক্স নেমে আসে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশে আর নিফটি ৮ দশমিক ৩০-এ।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের দরপতন ঘটেছে শেয়ারের। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গাড়ি কোম্পানি এবং এয়ারলাইনসগুলোর ব্যবসার অনেকটা পতন সাধিত হয়েছে।
করোনাভাইরাসে স্থায়ীত্বের মেয়াদ সম্পর্কে এই মুহূর্তে কোনো ধারণা না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে না৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে চরম বেকারত্ব ও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবার আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বৈঠকে বসেছে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরও কমেছে। অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে ৭ শতাংশ। এদিন প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ৩৩ ডলারে ২৩ সেন্টে দাঁড়ায়।
এদিকে রেকর্ড পরিমাণ দরপতন হয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও। রবিবার (৮ মার্চ) বিকালে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিন রোগীর সন্ধান পাওয়ার খবরে পরদিন পুঁজিবাজারে সূচকের বড় ধরণের পতন হয়। ওইদিন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)‘র প্রধান সূচক হারায় ২৭৯ পয়েন্ট। এটি ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স চালু হবার পর একদিনে সূচকের সর্বোচ্চ দরপতন।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জ্বা আজিজুল ইসলাম সান নিউজকে বলেন, এই দরপতনের পেছনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের অনেকের ধারণা যে করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে। এতে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি হয়তো ভালো ব্যবসা করতে পারবে না। আর ব্যবসা করতে না পারলে তাদের লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণও কমে যাবে। ফলে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাদের নিজেদের মধ্যে ভয়ানক ভীতির সঞ্চার হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান মুডিস এ্যানালিটিক্সের জেষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ ক্যাটরিনা এল বিবিসিকে বলেছেন, ব্যাপারটা ঠিক ভাইরাস নয়, বরং এই ভাইরাসকে কেন্দ্র করে যে ভীতি তৈরি হয়েছে সেটাই সমস্যা। আর এই অবস্থায় মানুষ যে অর্থনৈতিক আচরণ করছে, তাতে ক্ষতি এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে যে সেখান থেকে পা হড়কালে মহাবিপদ ঘটে যাবে।
Newsletter
Subscribe to our newsletter and stay updated.