মতামত
করোনা দুর্যোগ

ব্যাধির ব্যাধি সারাবে কে

হাসান আজিজুল হক


মানব জাতিকে ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে অদৃশ্য এক শক্তির বিরুদ্ধে। দৃশ্যমান অপশক্তিও কম নয়।। আমরা জানি, বিশ্বে কোনো সংক্রামক ব্যাধিই নির্মূল করা যায়নি টিকা প্রয়োগ ছাড়া। এ টিকা আবিস্কার-উৎপাদনে সময় লেগেছে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানী-গবেষকরা দ্রুততার সঙ্গেই করোনার টিকা আবিস্কারে সফলতা দেখিয়েছেন। বিশ্বে এখন বেশ কয়েকটি দেশ করোনার টিকা উৎপাদন করছে। কিন্তু তাতেও কুলাচ্ছে না। দেশে দেশে চলছে টিকার জন্য হাহাকার। আমরাও এর বাইরে নই।

সরকার দ্রুততার সঙ্গে প্রথমে কিছু টিকা আমদানি করলেও আমাদের প্রাপ্তির যে বড় উৎস ভারত; তাদের সঙ্গে আমরা চুক্তি করেও সেই নিরিখে টিকা পাইনি। তারপরও তারা আমাদের উপহার হিসেবে অনেক টিকা দিয়েছে। চীনও কম দেয়নি। উপহার এবং আমদানি করা টিকা মিলিয়ে পরিমাণটা এ পর্যন্ত যা দাঁড়াল তা চাহিদার অনুপাতে সামান্য। সরকারের নিরন্তর প্রয়াস রয়েছে বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের। আমাদের নিজেদের টিকা উৎপাদনে যাওয়ার কথা হয়েছে, কিন্তু তা গতিশীল করা যাচ্ছে না। এই টিকা বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ জুন সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে জানা গেল, বৈশ্বিক টিকা রাজনীতির ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ। টিকা সংকটকে পুঁজি করে উৎপাদক কোনো কোনো দেশ মুনাফা কিংবা অতি বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টা করছে- এ অভিযোগও উঠেছে। বিশ্বব্যাপী চলমান ভয়াবহ ব্যাধির প্রেক্ষাপটে সক্ষমদের সৃষ্ট এ আর এক ব্যাধি, যা মানব জাতির জন্য খুব পরিতাপের।

আমাদের সমাজ বাস্তবতায় করোনা ব্যাধির উপজাত আরও অনেক ব্যাধি কিংবা উপসর্গ দেখতে পাই। প্রাণঘাতী করোনা যখন নানা রকম অভিঘাতের ছায়া গাঢ় করেছে, তখনও দেখছি মানবতাবৈরী, সমাজবৈরী কত কাণ্ড! অনিয়ম, দুর্নীতি-ব্যাধিজর্জর এই সমাজে এত বড় দুর্যোগকে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষী অনেকেই উন্মত্ত হয়ে উঠল নিজেদের আখের গোছাতে। স্বাস্থ্য খাতের দায়িত্বশীল অসাধুরা নিজেদের উদরপূর্তি করতে অনাচার-কদাচারের অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটিয়ে চলল। রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার কতটা কী হলো- এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত আমাদের অভিজ্ঞতায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও থেমে থাকেনি হীনস্বার্থবাদী, দুর্নীতিবাজদের নানা রকম অপতৎপরতা। তাদের দ্বারা সৃষ্ট হতে থাকল ব্যাধির পর ব্যাধি।

আমরা নিয়ন্ত্রণমূলক পরিস্থিতি থেকে ফের বিস্ম্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম। সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের এই স্ম্ফীত চিত্র দ্বিতীয়, না তৃতীয় ঢেউয়ের মর্মন্তুদতা- এ নিয়ে তর্কে না জড়িয়েও বলা যায়, এ জন্য আমরা নিজেরাও কম দায়ী নই। বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমিত হয়েছিল প্রথমে ইতালি প্রত্যাগতদের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মধ্যে না রাখতে পারায়। সেই দুর্যোগ কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা প্রকট হচ্ছিল ভারতের পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে। আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে যখন এর ঢেউ এসে লাগল, তখন কাগজপত্রে নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ জারি করে সংক্রমণ গণ্ডিবদ্ধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত হলো বটে; বাস্তবে এসব কিছুর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে গেল। সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করা হলেও থেমে থাকেনি আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এবং ভারতে আটকাপড়াদের আগমন। তাদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থার দিকে সেভাবে নজর না দেওয়ায় আমাদের ঝুঁকি বেড়ে গেল। ব্যবস্থার অসংগতি কিংবা সমন্বয়হীনতা, মানুষের অপরিণামদর্শিতা ব্যাধির ব্যাধিকে করল আরও ভয়াবহ।

আমরা জানি, করোনাভাইরাস নামক অণুজীবাণুটি জীবন হন্তারক। কিন্তু এও তো জানি, এর প্রতিরোধ কঠিন নয়। সচেতনতা-সতর্কতা ও যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও এখন মোটামুটি জানেন কীভাবে করোনা সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু তা মানতেই যত অনীহা। আমার বসবাসস্থল রাজশাহীসহ এর আশপাশের জেলাগুলোর ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে- করোনা সংক্রমণের সামাজিক বিস্তৃতকরণের এ অবস্থার জন্য কি জনপরিসরে বিরাজমান উদাসীনতা, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ না করাই মুখ্যত দায়ী নয়? পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে করোনা-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির তরফে সারাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিন 'শাটডাউন'-এর সুপারিশ করা হলেও সরকার আপাতত ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে। যে নামেই ডাকি না কেন; ব্যবস্থার কার্যকারিতা না থাকলে সুফল মিলবে না। আমরা বিগত দিনে কার্যকর লকডাউনের সুফল পেয়েছিলাম।

আমাদের সমাজ-বাস্তবতায় যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সুযোগসন্ধানীরা ওঁৎ পেতে থাকে। এবারও এর ব্যত্যয় তারা ঘটায়নি। করোনা দুর্যোগে সরকার নানা রকম সামাজিক সহায়তামূলক কর্মসূচি হাতে নিল। খাদ্য সহায়তাসহ জীবনের জন্য কল্যাণকর অনেক কিছুর দিকেই অসাধুদের শ্যেনদৃষ্টি গভীর থেকে গভীরতর হলো। ত্রাণ লুটপাটের খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এলো। করোনা পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় অনিয়মের। এ রকম দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে আরও অনেক যেগুলো সমাজে ব্যাধি হিসেবে জিইয়ে আছে বছরের পর বছর। সরকারের অনেক মহৎ প্রচেষ্টাই অসাধুদের কারণে ব্যাহত হয়, হচ্ছে। দুর্যোগের ছায়া আবার যেভাবে গাঢ় হলো, এ থেকে নিস্কৃতি পেতে যেসব পথ যথাযথভাবে অনুসরণ করা জরুরি, তাতে যদি ব্যত্যয় ঘটে তাহলে ব্যাধির ব্যাধি বাড়তেই থাকবে। জীবন-জীবিকার সমন্বয় করে বিশ্বের করোনা আক্রান্ত অনেক দেশই স্বস্তির ঠিকানা ইতোমধ্যে খুঁজে পেয়েছে উপযুক্ত ব্যবস্থা কার্যকরের মধ্য দিয়ে। এ অঞ্চলের ছোট দেশ ভুটানও তা দেখিয়ে দিয়েছে।

করোনা দুর্যোগকে পুঁজি করে যারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে সামাজিক ব্যাধি আরও উৎকট করেছে, তাদের ছাড় নয়। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ সব ব্যবস্থা নিয়ে কঠোর দণ্ড নিশ্চিত করা হোক। চলমান বিস্ম্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জনস্বাস্থ্যবিদ ও করোনা-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির দায়িত্বশীলদের পরামর্শক্রমে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। 'ঢিলেঢালা' ব্যবস্থার ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব আমরা দেখেছি। সন্দেহ নেই, করোনা দুর্যোগ দারিদ্র্যের হার স্ম্ফীত করেছে। যারা জীবিকার আশায় নগর-মহানগর-শহরমুখী হয়েছিলেন, এখন তাদের বৃহদাংশ শিকড়মুখী হতে বাধ্য হয়েছেন, হচ্ছেন। কাজেই বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে গ্রামের দিকে নজর আরও গভীর করতে হবে। মানুষকে জীবিকার পথ করে দিতে হবে। আমাদের অনানুষ্ঠানিক শ্রম খাতে দৃষ্টি গভীর করতে হবে। বিপুলসংখ্যক কর্মহীনের কাজের ঠিকানা করার প্রয়াস জোরদার করতেই হবে। লকডাউন চলাকালে দরিদ্রদের সহায়তা কার্যক্রম জোরদার ও স্বচ্ছ করার বিকল্প নেই।

করোনার বৈশ্বিক সংক্রমণ যখন কমছে, তখন বাংলাদেশে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অতীতে আমরা সরকারের পাশাপাশি অনেক সামাজিক শক্তির সক্রিয়তা দেখেছি বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষের সহায়তার ক্ষেত্রে, যা এবার দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। বিত্তবান, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, এনজিওগুলোর হাত প্রসারিত হোক দুর্যোগে মানবকল্যাণে। নানা রকম প্রতারণা ও দুস্কর্মের জাল বিস্তারের পাশাপাশি নারী নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, সামাজিক অসহিষ্ণুতার ক্রমবর্ধমান ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। অনেকেই বলেছেন, এসবই করোনার বিরূপ প্রভাব। ভিন্নমত প্রকাশ করে বলতে চাই, করোনার আগে কি আমাদের সমাজে ভয়াবহ অপরাধ কিংবা দুস্ককর্ম প্রত্যক্ষ করিনি? মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতায় ধস আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকারের যথাযথ কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় অধিকতর নিষ্ঠ হতেই হবে।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার কাঠামোর ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা চলমান দুর্যোগেও ফের সামাজিক ব্যাধিই পুষ্ট করল। আরও কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হবে এ নির্বাচন। কী হবে সামনের দিনগুলোতে- এ শঙ্কাও শান্তিপ্রিয়দের তাড়া করছে। আমরা জানি, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ জনসমাগম। নির্বাচন কমিশন এ দুর্যোগে স্থানীয় সরকারের মতো বিস্তৃত একটি স্তরের নির্বাচনের আয়োজন করতে গেল কেন- এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। মহামারিকালে নিরুত্তাপ নির্বাচনেও সংঘাত-সহিংসতা ক্ষত সৃষ্টি করল। আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি! মানুষকে সচেতন-সতর্ক করতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারকে কঠোর হতেই হবে; কিন্তু মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বশীলরা যেন নিষ্ঠুর না হন। তারা যেন আবার ব্যাধির ব্যাধি সৃষ্টি না করেন। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

প্রস্তুতি ম্যাচের সূচি প্রকাশ

স্পোর্টস ডেস্ক : আসন্ন আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল আস...

কর্মস্থলে না এসেও বেতন তোলেন শিক্ষক

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ শনিবার (১৮মে) বেশ কিছু খেল...

মেঘনা নদীতে পাঙ্গাশ রক্ষায় অবৈধ চাই ধ্বংস 

ভোলা প্রতিনিধি: ভোলায় মেঘনা নদী থ...

মুন্সীগঞ্জে ভাসমান মরদেহ উদ্ধার

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মধ্য কোটগাঁ...

ওএমএস বিতরণে গাফলতি হলে ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক: খাদ্যমন্ত্রী সা...

পটল কেন উপকারী?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: আমাদের দেশের পরিচিত একটি সবজি হলো পটল। এই...

মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে

জেলা প্রতিনিধি: বিচারের আগে মিডিয...

হোয়াটসঅ্যাপে আসছে পরিবর্তন

টেকলাইফ ডেস্ক: জনপ্রিয় যোগাযোগ মা...

মঙ্গলবার ১৫৭ উপজেলায় সাধারণ ছুটি 

নিজস্ব প্রতিবেদক: ষষ্ঠ উপজেলা পরি...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা