মতামত

নতুন প্রজন্ম কি পূর্বসূরিদের সাফল্য ধরে রাখতে পারবে?

মোস্তাফিজ উদ্দিন

পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘উত্তরাধিকার পরিকল্পনা’ একটি অতিপরিচিত বিষয়। বয়স, স্বাস্থ্য বা অন্য যেকোনো কারণে একটি ব্যবসার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের অবসর গ্রহণের প্রয়োজন হয়; যা একটি স্বাভাবিক বিষয়। কাজেই বিদ্যমান নেতৃত্বের অবসর গ্রহণ বা মৃত্যুজনিত কারণে সৃষ্ট শূন্যতায় ব্যবসার হাল ধরা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই যোগ্য উত্তরসূরি চয়ন ও নির্বাচন করে রাখার প্রক্রিয়াই হলো ‘উত্তরাধিকার পরিকল্পনা’।

যেকোনো পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বস্তুত, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে এমন লোকজন থাকাটা খুবই জরুরি, যার বা যাদের ওপর প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের সময় নির্ভর করতে পারে এবং তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে কাজে লাগাতে পারে। এমনকি তারা প্রয়োজনে ব্যবসার নেতৃত্ব প্রদান করার সক্ষমতা রাখেন।

কিন্তু দেখা যায় যে উত্তরাধিকার বা উত্তরসূরি নির্বাচন পরিকল্পনায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই ভুল করে বসে। সঠিক পূর্বপরিকল্পনা না থাকায় বিদ্যমান নেতৃত্ব যখন ব্যবসা থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাদের অবর্তমানে ব্যবসায় নেতৃত্ব দেয়ার মতো সঠিক ও যোগ্য লোকটি খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিষ্ঠানেরও অবসান ঘটে।

আমাদের পোশাক শিল্পের বেলায় এ উত্তরাধিকার পরিকল্পনার তত্ত্বটি কতটা প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য? ধরুন, আমাদের পোশাক শিল্প একটি বিশাল পারিবারিক ব্যবসা। আগামী দিনে এ শিল্পের সম্মুখে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবেলা করার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা আগামী দিনে এ ব্যবসার হাল ধরবেন, তারা এ শিল্পের সামনে যে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা মোকাবেলা করে এ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন তো? আমাদের শিল্পের সামনে এখন এ প্রশ্ন। আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি, আমাদের কাছে এর সদুত্তর রয়েছে।

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের পোশাক শিল্পের ইতিহাসের দিকে একটু তাকাতে হবে। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের হাত ধরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। গত চার দশকে আমাদের পোশাক শিল্প বহু পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই গর্ব করার মতো অবস্থানে পৌঁছেছে।

তবে এ শিল্পের শুরুর দিকে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কেননা তখন এ শিল্পের সম্ভাবনা বা ভবিষ্যতের ব্যাপারে কারো তেমন একটা ধারণা ছিল না। তারা বিভিন্নভাবে এ পোশাক শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, যা কিনা অনেকটা দিকনির্দেশক কম্পাসবিহীন সমুদ্রে যাত্রার মতো। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো কল্পনাই করতে পারেননি যে বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে।

গত চার দশকে পোশাক শিল্প বহু চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে অনেক চ্যালেঞ্জ। এ যেন শিল্পের এক অনন্যসাধারণ ও নজিরবিহীন অগ্রযাত্রা। বর্তমানে পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ অর্জিত হয় পোশাক রফতানি থেকে। এ শিল্প বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং জিডিপিতে পোশাক শিল্পের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। বহু লোককে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করেছে পোশাক শিল্প।

আর এজন্য আমরা তৈরি পোশাক শিল্পের প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণী। তাদের অবদানে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে মর্যাদা লাভ করতে পেরেছি।

বাংলাদেশের উন্নয়ন এ শিল্পের উন্নয়নের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল বললে অত্যুক্তি হবে না। চার দশক ধরে আমরা শিল্প সম্পর্কে যে বিশাল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা সত্যিই আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। একই সঙ্গে এ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক বিশাল দায়িত্বও আমাদের কাঁধে।

আমাদের পোশাক শিল্প আজ এমন এক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে উত্তরাধিকার পরিকল্পনার বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারা এ শিল্পের আগামী দিনের কাণ্ডারি হবে? বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার দরুন শিল্পের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে, সেগুলো মোকাবেলা করে শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করবে কে? প্রশ্নগুলো কিন্তু এসেই যায়।

বর্তমানে প্রথম প্রজন্মের অনেক উদ্যোক্তাই ব্যবসার দায়িত্ব তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের এ উদ্যোক্তাদের মনমানসিকতা অনেক ক্ষেত্রেই একটু ভিন্ন ধারার। তরুণ এ প্রজন্মের কাছে নতুন ও ব্যতিক্রমধর্মী ধারণা পছন্দনীয়।

শিল্পে প্রচলিত অতীতের গতানুগতিক ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু করার সামর্থ্য আগামী প্রজন্মের রয়েছে, যা শিল্পের জন্য মন্দ নয়। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পোশাক শিল্প লক্ষণীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের মাঝে গতানুগতিক পণ্য ও উৎপাদন প্রক্রিয়া আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশে পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করেছিল প্রায় চার দশক আগে। কিন্তু এখনো আমাদের পোশাক শিল্প বেসিক পণ্য উৎপাদনের মধ্যে আটকে আছে।

আশার কথা, আমাদের নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্ন ধারায় চিন্তা করছেন। পণ্যের ডিজাইন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উন্নয়নের নিমিত্তে এসব উদ্যোক্তা তাদের কারখানায় নিজস্ব আরঅ্যান্ডডি স্থাপন করছেন এবং উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদনের প্রতি মনোনিবেশ করছেন।

দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগ বিদেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা উচ্চশিক্ষিত। এর মানে হলো, তারা বর্তমান বিশ্বের নিত্যনতুন আইডিয়া বা ধারণা এবং প্রযুক্তির সঙ্গে সম্যক পরিচিত। আমাদের বুঝতে হবে যে পুরনো প্রযুক্তি বা কৌশল, যা আগের দিনে কাজ করত, তা আগামী দিনের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমাদের শিল্প তথা শিল্পসংশ্লিষ্ট সবাইক বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। নতুন প্রজন্ম এ বার্তাই সবার কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছেন।

কাজেই আমাদের আগামী প্রজন্ম আধুনিক উৎপাদন কৌশল, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে মনোনিবেশ করছেন। তারা মনে করেন যে সাসটেইনেবিলিটি ও স্বচ্ছতা ব্যবসারই অবিছেদ্য অংশ। তারা আরো বিশ্বাস করেন, ‘জ্ঞানই শক্তি’ এবং শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে সেই জ্ঞান সতীর্থদের মাঝে বিনিময় করতে সর্বদাই অত্যন্ত আগ্রহী।

নতুন প্রজন্মই আগামী দিনের কাণ্ডারি। কিন্তু অতীত থেকেও নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তারা ভিন্নভাবে কাজ করতেন এবং তাদের কাছ থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। আগের প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন, দৃঢ় সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রমের ফসলই হচ্ছে আমাদের বর্তমান পোশাক শিল্প। তারা বিশ্ব থেকে এ পোশাক শিল্প সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং কঠোর পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন এ শিল্প।

তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফসল হিসেবে গড়ে ওঠা এ শিল্পের কারণে বিশ্বের প্রতিটি ব্র্যান্ড বা ক্রেতার কাছে বাংলাদেশ আজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটা যে কত বড় সাফল্য, তা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না।

আর তাই যাদের হাতে এ শিল্পের গোড়াপত্তন ও সাফল্য অর্জন, তাদের প্রতি আমাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের হাত ধরে আমরা উজ্জ্বল আগামীর দিকে এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে চাই। তাই সাফল্যের জন্য চাই যথার্থ উত্তরাধিকার পরিকল্পনা।

আমার বিশ্বাস, এদিক থেকে বাংলাদেশ একটি সুসংহত অবস্থানেই রয়েছে। আমাদের আগামী প্রজন্ম বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ও প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে এবং পোশাক শিল্পকে উন্নয়নের এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

মোস্তাফিজ উদ্দিন: ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের

ব্যবস্থাপনা পরিচালক; বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উত্তরায় প্রাইভেটকারে অপহরণ; ভিডিও ভাইরালের পর গ্রেপ্তার ২

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনায় অপহরণে ব্যবহৃত একটি প্রাইভে...

আমাকে চেয়েছিলো যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী বানাতে: ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত সরকারের সময় তিনবার...

ভালুকায় সৌন্দর্য বাড়াতে ইউএনও’র ‘নিজ খরচে’ সবুজ বিপ্লব

ভালুকা উপজেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও নগর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নি...

কালীগঞ্জে ফিল্মিস্টাইলে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জে...

সড়কহীন ৩৪ কোটি টাকার সেতু

সেতু আছে কিন্তু সংযোগ সড়ক করা হয়নি এমন সেতু ফেনীতে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা