আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চলমান করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনৈতিকভাবে টালমাটাল দেশটির মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী। কিন্তু এই কষ্ট ছাপিয়ে কাতার বিশ্বকাপে মহাকাব্যিক জয়ের উচ্ছ্বাসে মেতেছেন আর্জেন্টিনার জনগণ।
আরও পড়ুন : বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা
ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় চারদিকে ফাটছে আতশবাজি, বাজছে গাড়ির হর্ন, চলছে নাচ-গান। উড়ানো হচ্ছে জাতীয় পতাকা।
সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপ ফাইনালের নির্ধারিত সময়ে ৩-৩ গোলে ম্যাচ শেষ হয়। এরপর পেনাল্টিতে গোল রক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের দুর্দান্ত প্রতিরোধে জয় পায় লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা।
সেন্ট্রাল বুয়েনস আয়ার্সের একটি ক্যাফে থেকে ৩১ বছর বয়সী জোয়েল সিয়ারালো নামের একজন আর্জেন্টাইন বারবার বলতে থাকেন, এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
জোয়েল সিয়ারালো আরও বলেন, এই সংগ্রাম তাদের ভাগ্যে ছিল। এটি আর্জেন্টাইন হওয়ার শর্ত।
আরও পড়ুন : আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের একাদশ ঘোষণা
রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের বড় পর্দায় খেলা দেখা একজন বলেন, এটা কাব্য, এটা মহাকাব্য। এ রকম সংগ্রামই আর্জেন্টাইনদের ইতিহাস।
প্রসঙ্গত, বিগত কয়েক বছর ধরেই অর্থনৈতিক সংকট এবং দুর্দশায় ভুগছে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবনা যেন তাদের জন্য দুঃসহ। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে অসহনীয়।
২৫ বছর বয়সী টেম্পারলির একজন নির্মাণ শ্রমিক ফাইনাল ম্যাচ দেখতে বুয়েনস আয়ার্সে এসে বলেন, আর্জেন্টিনা বর্তমানে এমন একটি দেশ যেটি চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোই জটিল হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন : গোল্ডেন বল জিতলেন মেসি
সেই নির্মাণ শ্রমিক আরও জানান, তবে যাই হচ্ছে না কেন এই জয়টি আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান ও প্রাপ্য।
লকস্মিথ গ্যাব্রিয়েল এসকালান্তে দেশের এই জয়ের জন্য জাতীয় দলের কোচ লিওনেল স্কালোনিকে জানিয়েছেন শ্রদ্ধা।
সেনেটেনারিও পার্ক থেকে এসকালান্তে আরও বলেন, সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তারা চাপে ছিল। কোচ অসাধারণভাবে তার কাজ সম্পন্ন করেছেন।
৩২ বছর বয়সী সার্জিও লরেটো নামের একজন আর্জেন্টাইন বলেন, তারা এই জয়ের যোগ্য।
আরও পড়ুন : আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, আর কোনো কথা নেই
উল্লেখ্য, ফাইনাল ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই দেশটির সেন্ট্রাল বুয়েনস আয়ার্সের আইকনিক ওবেলিস্কের চারপাশের চত্বরটি লোকজন আসতে শুরু করে। খেলাধুলায় বিজয় উদযাপনের জন্য এটি আর্জেন্টিনার ঐতিহ্যবাহী স্থান।
আর্জেন্টিনার জয় নিশ্চিত হওয়ার পরে হাজার হাজার মানুষ শহরের কেন্দ্রস্থলে নেমে আসে। যেখানে চোখ যায়, শুধু মানুষ। একই সঙ্গে আসতে থাকে সুমধুর ধ্বনি। কারণ ৩৬ বছর পর স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছে তারা।
সোলেদাদ প্যালাসিওস নামের একজন বলেন, আমার বয়স ৩৫ বছর। আর এই মুহূর্তের জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে সেই থেকে। এই জয় আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
২১ বছর বয়সী নাহুয়েল ক্যান্টেরো বলেন, এই জাতীয় দলটি সবাইকে একত্রিত করেছে। সব দ্বন্দ্ব ভুলে সবাই একই কাতারে এসছে। এটাই সুন্দর দৃশ্য।
আরও পড়ুন : ফ্রান্সেরও অনেকে চায় মেসি বিশ্বকাপ জিতুক
২৩ বছর বয়সী মার্টিন রেইনা বলেন, এই দলটি সবকিছুরই যোগ্য। বিশেষ করে মেসির জন্য এটি অসাধারণ অর্জন।
কারণ তিনি কখনই ক্লান্ত বা আশা ছাড়েননি। সব কিছু ছাপিয়ে জয় উদযাপনে উচ্ছ্বাসে মেতেছেন আর্জেন্টাইনবাসী। সূত্র: বুয়েনস আয়ার্স টাইমস।
দক্ষিণ আমেরিকার একটি রাষ্ট্র আর্জেন্টিনা। দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী বুয়েনোস আইরেস। দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশের প্রায় পুরোটা জুড়ে দেশটি অবস্থিত। আয়তনের দিক থেকে এটি দক্ষিণ আমেরিকার ২য় বৃহত্তম এবং বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম রাষ্ট্র।
আর্জেন্টিনার ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু বিচিত্র। উত্তরের নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণের মেরু-উপদেশীয় অঞ্চল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার বিস্তার। এর মধ্যেই আছে রুক্ষ আন্দেস পর্বতমালা ও তার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আকোনকাগুয়া।
আরও পড়ুন : ফাইনালে আর্জেন্টিনার সম্ভাব্য একাদশ
তবে বেশির ভাগ লোক দেশটির মধ্যভাগে অবস্থিত বিশাল উর্বর প্রেইরি সমভূমির (যার নাম পাম্পাস) শহরগুলিতে বাস করেন। পাম্পাসেই দেশটির অধিকাংশ কৃষিসম্পদ উৎপন্ন হয় এবং এখানেই দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত কাউবয় "গাউচো"-দের আবাসস্থল।
আর্জেন্টিনায় আরও আছে অরণ্যভূমি, মরুভূমি, তুন্দ্রাভূমি, সুউচ্চ সব পর্বতশৃঙ্গ, নদনদী এবং হাজার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূলভূমি।
এছাড়া দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের অনেকগুলি দ্বীপ আর্জেন্টিনা নিজেদের বলে দাবি করে, যার মধ্যে ব্রিটিশ-শাসিত ফকল্যাণ্ড দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম (আর্জেন্টিনীয়রা এগুলিকে মালবিনাস দ্বীপপুঞ্জ নামে ডাকে)। এর বাইরে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের একটি অংশও আর্জেন্টিনা নিজের বলে দাবি করে।
আরও পড়ুন : স্বপ্নের ফাইনালে আর্জেন্টিনা
অর্থনীতি :
আর্জেন্টিনার অর্থনীতিকে প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতা, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, রপ্তানিমুখী কৃষিখাত এবং একটি বৈচিত্র্যময় শিল্প ভিত্তি দ্বারা চরিত্রায়িত করা যায়। আর্জেন্টিনা বর্তমানে একটি উন্নয়নশীল দেশ। এটির অর্থনীতিটি ব্রাজিলের অর্থনীতির পরে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।
কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দেশটির অর্থনৈতিক সাফল্য খুবই অসম প্রকৃতির, যেখানে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গুরুতর অর্থনৈতিক মন্দার অবিরাম পালাবদল পরিলক্ষিত হয়। এই ব্যাপারটি ২০শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে প্রকট রূপ ধারণ করেছে। একই সময়ে আয়ের দুর্বণ্টন ও দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মাথা পিছু স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হিসেবে আর্জেন্টিনা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দশটি দেশের একটি এবং সেসময় সেটি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে পাল্লা দিত এবং ফ্রান্স ও ইতালিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি একটি উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ।
আরও পড়ুন : রোমাঞ্চকর জয়ে সেমিতে আর্জেন্টিনা
তবে এখনও মানব উন্নয়ন সূচকে আর্জেন্টিনা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে আছে।
২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসো-র মানের ৫০% পতন ঘটে এবং এর পর দেশটিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের জরুরি সহায়তা ব্যবস্থার অধীনে (স্ট্যান্ড-বাই অ্যারেঞ্জমেন্ট) আনা হয়। ২০১৯ সালে পেসো-র মূল্য আরও ২৫% হ্রাস পায়।
ফুটসি গ্রুপের বৈশ্বিক মালিকানা সূচকের ২০১৮ সালের সংস্করণ অনুযায়ী আর্জেন্টিনাকে একটি উদীয়মান বাজার হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া এটিকে মুখ্য জি-২০ অর্থনীতিগুলির একটি হিসেবেও গণনা করা হয়।
সান নিউজ/এইচএন