সারাদেশ

তাঁতশিল্পে করোনার থাবা, সংকটে শ্রমিকদের দিন

নিজস্ব প্রতিনিধি, টাঙ্গাইল : করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় চরম সংকটের মুখে পড়েছে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প। করোনার প্রথম ঢেউয়ে অস্থায়ী মনে হলেও ক্রমশ তাঁতপল্লীর অবস্থা স্থায়ী সংকটের দিকে যাচ্ছে। প্রতি বছর বৈশাখ ও ঈদসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে তাঁতিরা কাপড় বোনাতে চরম ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এবার তাঁতপল্লীতে কোনও ব্যস্ততা-ই নেই। এখনও জেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য তাঁত বন্ধ রয়েছে। ফলে এ শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে তাঁতশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, করোনার প্রথম ঢেউয়ে লকডাউনে তাঁতে কাপড় তৈরিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল। দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের কবলে পড়ে ওই সময় অসংখ্য তাঁত শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। ফলে শ্রমিকরা তাদের পরিবার নিয়ে পড়েন চরম বিপাকে। বেঁচে থাকার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দেয় অসংখ্য শ্রমিক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর রমজানের আগ মুহূর্ত থেকে কিছু কিছু তাঁত খুলতে শুরু করেছে তাঁতিরা।

তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুরে দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য একটি) বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুইটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লায় এ দুইটি বেসিক সেন্টারের নিয়ন্ত্রণে ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি এবং ৪টি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ৩০ হাজারের উপরে তাঁত রয়েছে। এখনও অসংখ্য মালিকের তাঁত বন্ধ রয়েছে।

করোনা মহামারির সঙ্গে গত বন্যার ভয়াল থাবায় জেলার তাঁতশিল্পকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরিতে তাঁত মালিকদের বিনিয়োগ বিনষ্ট হচ্ছিল। সেই সঙ্গে বন্যার পানি প্রবেশ করে ফ্যাক্টরিতে চালু তাঁত, তাঁতে থাকা সুতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদি প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যায়। এরপরও তাঁতশিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। এরইমধ্যে সুতা, রঙ, রাসায়নিক কেমিক্যাল ও তাঁতের অন্যান্য সরঞ্জামাদির দামও বেড়ে যায়। এ পেশায় এক লাখ তিন হাজারেরও বেশি তাঁত শ্রমিক সম্পৃক্ত। তাঁতপল্লীতে কেউ শাড়ী বুনেন, কেউ চরকায় সুতা কাটেন, কেউ কাপড়ের নকশার সুতা কাটেন। আবার সুতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার কাজ করে থাকে এ পেশায় সম্পৃক্তরা। করোনার প্রথম ঢেউয়ে পুরো তাঁতিরাই কর্মহীন হয়ে পড়ে।

তাঁতপল্লী ঘুরে জানা যায়, করোনার কারণে প্রথমে শাড়ী বানানোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আসে। ফলে তাঁত বন্ধ রাখে মালিক পক্ষ। লম্বা সময় তাঁত বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা। সংসার চালাতে পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যায় শ্রমিকরা। করোনার প্রথম ধাপে করটিয়া শাড়ী বিক্রির হাট বন্ধ আর শো-রুমগুলোতে ক্রেতা না থাকায় শাড়ী উৎপাদন করেনি মালিক পক্ষ। এরপর শাড়ী হাট আর শাড়ী বানানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও এখনও প্রায় ক্রেতাশূন্য তাঁতপল্লী। একদিকে ক্রেতাশূন্য অন্যদিকে শ্রমিকের অভাবে অধিকাংশ তাঁত বন্ধ করে দিয়েছে মালিক পক্ষ।

এদিকে কেউ কেউ অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন পেজ খুলে শাড়ী বিক্রির চেষ্টা করছে। অনলাইনে কিছুটা বিক্রি হলেও ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার মতো শাড়ী বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও অনলাইন ভিত্তিক শাড়ী ব্যবসায়ী মনি ট্রেডার্স।

পাথরাইলের চণ্ডী এলাকার তাঁত শ্রমিক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘করোনার প্রথম পর্যায়ে কাপড় তৈরি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। কাজ বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে অনেক সমস্যায় ছিলাম। রমজানের মাত্র কয়েকদিন আগে থেকে আবার কাপড় তৈরি শুরু হয়েছে। অন্যান্য বছর বিশেষ দিনগুলোর জন্য কাপড় তৈরিতে তাঁতিরা ব্যাপক ব্যস্ততায় দিন কাটায়। কিন্তু এবার ঈদকে সামনে রেখেও তেমন ব্যস্ততা নেই তাঁতিদের মাঝে।’

পাথরাইলের তাঁত মালিক মন্তোষ বসাক বলেন, ‘আমার ১২টি তাঁত রয়েছে। আগে বেশ ভালোভাবেই চললেও করোনার কারণে দীর্ঘদিন তাঁত বন্ধ ছিলো। রমজানের কয়েকদিন আগে আবার চালু করেছি। এখনও এ এলাকায় ৮০ শতাংশ তাঁত বন্ধ রয়েছে। ফলে তাঁত শ্রমিকরা অন্য পেশায় চলে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সুতার দাম আগে ছিল ২৫০ টাকা এখন সেই সুতা সাড়ে ৯শ’ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন মহাজনের কাছ থেকে দাদন এনে তাঁত চালাচ্ছি। মহাজনরা আমাদের শুধু পারিশ্রমিক দিচ্ছেন।’

কাপড় ব্যবসায়ী মুন্নাব মিয়া বলেন, ‘করোনার কারণে আমার ব্যবসা প্রায় ৭ মাস বন্ধ ছিল। ওই সময় টাকা-পয়সা ঋণ করে কোনওরকমে সংসার চালিয়েছি। এখন আবার কাপড়ের ব্যবসা চালু করেছি। বর্তমানে হাটে কিছু কিছু কাপড় বিক্রি করা যাচ্ছে।’

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত চণ্ডী-পাথরাইল শাড়ী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘ঈদকে সামনে রেখে আমাদের আগের উৎপাদনের কিছু কিছু কাপড় বিক্রি চলছে। তাঁতে আশার আলোও দেখা দিয়েছিল। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসা শুরু করেছিলো। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার থামিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ঈদকে কেন্দ্র করে নতুন করে সীমিত পরিসরে তাঁত চালু হলেও কাপড় উৎপাদনের সাহস পাচ্ছি না। এখনও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক ও টাকার অভাবে অসংখ্য তাঁত বন্ধ রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু আমরা চাই আমাদের উৎপাদিত দ্রব্য সঠিক বাজারজাত করার। সঠিক বাজারজাত হলেই আমাদের উৎপাদনের প্রক্রিয়াজাত বেড়ে যাবে। কাপড় বাজারজাত করার জন্য আমরা সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।

সান নিউজ/এসএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উত্তরায় প্রাইভেটকারে অপহরণ; ভিডিও ভাইরালের পর গ্রেপ্তার ২

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনায় অপহরণে ব্যবহৃত একটি প্রাইভে...

আমাকে চেয়েছিলো যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী বানাতে: ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত সরকারের সময় তিনবার...

ভালুকায় সৌন্দর্য বাড়াতে ইউএনও’র ‘নিজ খরচে’ সবুজ বিপ্লব

ভালুকা উপজেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও নগর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নি...

কালীগঞ্জে ফিল্মিস্টাইলে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জে...

সড়কহীন ৩৪ কোটি টাকার সেতু

সেতু আছে কিন্তু সংযোগ সড়ক করা হয়নি এমন সেতু ফেনীতে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা