নুরুল আজিজ চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আজগর হাজী ওয়াক্ফ এস্টেট এর ৫ একর ৬২ শতাংশ সম্পদ গ্রাস করেছে মোতওয়াল্লীসহ একটি প্রতারক চক্র।
প্রতারিত ক্রেতাদের মাঝে দেখা দিয়েছে জমি হারানোর হতাশা। বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসক কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দফতরে লিখিত আবেদন করলেও বার্তমান বাজারে প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের এই জমি উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আবেদনকারী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আমিনুল হক ভূঁইয়া রাজু, স্থানীয় মসজিদ কমিটির লোকজন, জনপ্রতিনিধি ও রাজতৈতিক নেতারা।
জানা গেছে, সিদ্ধিরগঞ্জ মৌজার আরএস ঊনিশটি দাগে ৪৫৭ ও জালকুড়ি মৌজায় আরএস তিনটি দাগে ১০৫ শতাংশ জমিসহ মোট ৫৬২ শতাংশ জমি আজগর হাজী ওয়াক্ফ এস্টেটের। ১৯৩২ সালে আজগর হাজি এই জমি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করেন। যার ওয়াক্ফ তালিকাভুক্ত স্বারক ইসি নম্বর-১৮২৫৪। জমির অবস্থান মিজমিজি দক্ষিণপাড়া এলাকায়। বিভিন্ন মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এই ওয়াক্ফ জমি বিক্রি করে সমস্ত টাকা আত্মসাত করেছে প্রভাবশালী মহল। বর্তমান বাজারে ওই জমির মূল্য ১৫ লাখ টাকা কাঠা বলে জানায় স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানায়, আজগর হাজীর মৃত্যুর পর তার ছেলে দবু মোহাম্মদ, নূর মোহাম্মদ ও দিল মোহাম্মদ সত্য গোপন করে ওয়াক্ফ জমি বিক্রি করে। তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানরাও একইভাবে জমি বিক্রি করে। পরবর্তীতে মৃত দবু মোহাম্মদের ছেলে আলি হোসেন ও আব্দুল মতিন ওরফে মতিন পাললা, মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে শুক্কুর আলি এবং একই এলাকার মিয়াচানের ছেলে কামাল প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ওয়াক্ফ জমি বিভিন্ন লোকদের কাছে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু তারাই নয় মিজমিজি দক্ষিণ পাড়া জামে মসজিদ ওয়াক্ফ এস্টেট এর পক্ষে মোতওয়াল্লা মো. রফিক মিয়া ও মো. জহিরুল ইসলাম (বর্তমানে দুই জনই মৃত) বিক্রি করেন ৫৩ শতাংশ। জমি বিক্রির টাকা দুই মোতওয়াল্লী মসজিদের কাছে না লাগিয়ে নিজের বাড়ি নির্মাণ করেছে বলে জানান মসজিদ কমিটির সভাপতি হাজি মো. মোস্তফা কামাল ও স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি।
হাজি মো. মোস্তফা কামাল জানান, সে সময় জহিরুল ইসলাম ছিলেন, সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। তিনি কারো সঙ্গে কোন পরামর্শ না করেই জমি বিক্রি করেন। একই এলাকার বাইতুল সালাম জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. আলি হোসেন ভূঁইয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ওয়াক্ফ প্রশাসক কার্যালয়ে ঘুরেও কোন লাভ হচ্ছে না। তাদের নিক্রিয়তায় ওয়াক্ফ জমিতে বাসা বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে।
ওয়াক্ফ জমি উদ্ধার করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন মসজিদ কমিটির লোকজন সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মসজিদ কমিটির পক্ষে আমিনুল হক ভূঁইয়া রাজু ওয়াক্ফ প্রশাসক, জেলা প্রশাসক, ভূমি মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিত আবেদন করেছেন। পাশাপাশি ওয়াক্ফ জমি সনাক্ত করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সহযোগীতা পেলেও এড়িয়ে যাচ্ছে ওয়াক্ফ প্রশাসক কর্তৃপক্ষ। কোটি কোটি টাকার ওয়াক্ফ জমি কয়েক দফা বেচা কিনা হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পরও ওয়াক্ফ প্রশাসকের কোন লোক সরেজমিনে পরিদর্শন করতে আসেননি। এমনকি জমি উদ্ধার করতে কোন প্রদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এতে ওয়াক্ফ প্রশাসক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা রহস্যনজক মনে হচ্ছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি ইয়াছিন মিয়া জানান, আজগর হাজি ধর্মিক লোক ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি মসজিদ ও ধর্মিয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য এই জমি ওয়াক্ফ করে দেন। তার মৃত্যুর পর ওয়ারিশগণ ও মোতওয়াল্লীরা অনিয়ম তান্ত্রিকভাবে জমি বিক্রি করে অর্থ আত্মসাত করেন। ওয়াক্ফ জমি উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইকবাল হোসেন জানান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করা ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ আত্মসাত করা দুঃখজনক। যারা কিনেছে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এই জমি উদ্ধার করতে ওয়ার্ডবাসীকে সঙ্গে নিয়ে যা প্রয়োজন তাই করবো।
ওয়াক্ফ জমি ক্রেতা মো. কবির হোসেন জানায়, আমি ছয় শতাংশ কিনেছি। তবে জানতাম না যে এই জমি ওয়াক্ফ করা। জানলে কিনতাম না। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলি হাজি ও তমু হাজির কাছ থেকে কিনেছি। একই কথা বলেন ক্রেতা নাসির উদ্দিন, আহম্মেদ হোসেন মজুমদার ও মোহাম্মদ আলি। আরো অনেক ক্রেতাই ওয়াক্ফ জমি কিনে প্রতারিত হয়েছে দাবি করে বলেন, বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিবেন তারা।
জমি বিক্রিকারী আজগর হাজির নাতি আলি হোসেন জানান, আমি কোন ওয়াক্ফ জমি বিক্রি করিনি। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া অংশের কিছু বিক্রি করেছি আর কিছু ভোগদখলে আছি। এই জমি বিক্রিকারী অন্যরা মারা গেছেন।
ওয়াক্ফ পরিদর্শক রেজাউল করিমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, যদি ওয়াক্ফ কার্যলয়ে এন্ডল হওয়ার পর বিক্রি হয়ে থাকে তাহলে অফিসের নিয়োগপ্রাপ্ত মোতওয়ালী আবেদন করলে ওয়াক্ফ আইনের ৬৪ ধারায় বেদখলকৃত জমি উচ্ছেদের মাধ্যমে দখল মুক্ত করা হবে।
সান নিউজ/কেটি