মতামত

আগুনে পুড়ে শ্রমিকের মৃত্যুর দায় কার

তাসলিমা ইয়াসমীন : তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুনের ১০ বছর পার হওয়ার আগেই হাসেম ফুডসের কারখানায় আগুনে পুড়ে প্রাণ গেল আরও অর্ধশতাধিক শ্রমিকের। এত নামীদামি একটি কারখানা এত বছর ধরে দেশের আইনকানুন আর কর্তৃপক্ষের তোয়াক্কা না করে কীভাবে ব্যবসা চালিয়ে গেল, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তায় আমাদের যা আইনকাঠামো আছে, তাতে ঘাটতি রয়ে গেছে, নাকি কর্তৃপক্ষের দক্ষতার ঘাটতি, নাকি স্বচ্ছতার অভাব—এসব প্রশ্নের উত্তর বের করাও জরুরি।

অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রথমেই নজরে আসে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ভূমিকা। তবে আগুন লাগলে তা নেভানো এবং উদ্ধারকাজের পাশাপাশি আগুনের ঝুঁকি প্রতিরোধের ব্যবস্থা জোরদার করাও কিন্তু এই অধিদপ্তরের দায়িত্ব। আইন অনুযায়ী বহুতল ভবনসহ যেকোনো বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে ফায়ার লাইসেন্স ইস্যু করা এবং তা বছর বছর পরিদর্শন করে নবায়ন করার কথাও এ অধিদপ্তরের। কিন্তু হাসেম ফুডসের কারখানার আগুনের ঘটনায় দেখা গেল, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আগুন নেভাতে গিয়েই বরং প্রথম জানতে পারলেন, কোনো ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাই কারখানাটিতে ছিল না। খতিয়ে দেখা দরকার, এ কারখানায় যদি কোনো ফায়ার লাইসেন্স থেকে থাকে, তবে সেই লাইসেন্স কোন বিবেচনায় ইস্যু বা নবায়ন করা হয়েছিল; আর যদি লাইসেন্স না থাকে, তবে কী করে এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিসের নজর এড়িয়ে গেল। সে দায়দায়িত্বের প্রশ্নটিরও উত্তর খোঁজা দরকার।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনসংক্রান্ত আলাদা অধিদপ্তর থাকা সত্ত্বেও কেন বড় বড় দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না, সে প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ সময়ই পরিদর্শকের সংখ্যার অপর্যাপ্ততার বিষয়টি উঠে আসে। যদিও কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যাবে, পরিদর্শকের সংখ্যা নিশ্চিতভাবে অপ্রতুল। তবে নতুন পরিদর্শক নিয়োগ করলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানোর আগে বিবেচনা করা দরকার যতটুকু পরিদর্শন বর্তমান লোকবল নিয়ে করা সম্ভব ছিল, ততটুকুই সঠিকভাবে করা হয়েছে কি না। সে সঠিক-বেঠিকের মানদণ্ড ঠিক করা আমাদের মতো সাধারণ জনগণের জন্য অবশ্য কষ্টসাধ্য। কেননা, সরকারি পর্যায়ে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে একটি নির্দিষ্ট কারখানায় পরিদর্শনের কারণে নিরাপত্তাব্যবস্থার আদৌ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হলো কি না, তা জানা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে এ অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ড আসলে কতটুকু সফল, তার স্পষ্ট তথ্য উপস্থাপন করা জরুরি, যাতে পুরো অধিদপ্তরের একটি জবাবদিহির জায়গা তৈরি হয়।

পরিদর্শন নিয়ে যে স্বল্পসংখ্যক গবেষণা হয়েছে, সেখানেও এ ধরনের তথ্য উঠে আসে, যেখানে কোনো পরিদর্শকের বিরুদ্ধে যেমন কারখানার মালিকের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি মালিকপক্ষের প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কোনো পরিদর্শক ইচ্ছা করলেও সঠিকভাবে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না—এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। সুতরাং প্রতিটি বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার আর এ কারণেই পরিদর্শন অধিদপ্তরের কাজের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

পরিদর্শনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়, তা কতটা যুক্তিসম্মত, অর্থাৎ সেখানে অগ্রাধিকার নির্ণয় করার সময় সঠিক ঝুঁকি নির্ণয়ের মাধ্যমে অগ্রাধিকার খাতের তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে কি না, তা দেখা জরুরি। পরিদর্শনের প্রক্রিয়াতেও নিরাপত্তার ঝুঁকি বিবেচনায় কিছু অগ্রাধিকারের বিষয় থাকা প্রয়োজন।

যে পরিমাণ জনবল রয়েছে, তার উপযুক্ত ব্যবহার করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে পরিদর্শন অধিদপ্তরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিদর্শন করতে হয়। পরিদর্শনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়, তা কতটা যুক্তিসম্মত, অর্থাৎ সেখানে অগ্রাধিকার নির্ণয় করার সময় সঠিক ঝুঁকি নির্ণয়ের মাধ্যমে অগ্রাধিকার খাতের তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে কি না, তা দেখা জরুরি। পরিদর্শনের প্রক্রিয়াতেও নিরাপত্তার ঝুঁকি বিবেচনায় কিছু অগ্রাধিকারের বিষয় থাকা প্রয়োজন।

একজন পরিদর্শককে প্রতিটি পরিদর্শনে একজন শ্রমিকের বেতন-ভাতা, চাকরির শর্তাবলিসহ অন্য সব কল্যাণমূলক বিধান পালন করা হচ্ছে কি না, তা যেমন দেখতে হয়, একই সঙ্গে সেসব ঝুঁকি যা কিনা শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত, সে বিষয়গুলোও দেখতে হয়। আগুন, বিদ্যুৎ ও কাঠামোগত নিরাপত্তার মতো কারিগরি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে একটি বিস্তারিত নিরীক্ষণ প্রয়োজন—বর্তমানে পরিদর্শনে ব্যবহৃত চেকলিস্টে টিকচিহ্ন প্রদানের মাধ্যমে তা কার্যকরভাবে সম্ভব হয় কি না, সে বিষয়ও ভেবে দেখা দরকার।

আরও একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে—কিছু প্রায়োগিক বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করা সম্ভব কি না। যেমন ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রস্তুত করা, কারখানার নকশার লে আউট বিশ্লেষণ করা, নবায়নের সময় একটি প্রাথমিক পরিদর্শন প্রতিবেদন অধিদপ্তরকে জমা দেওয়াসহ ইত্যাদি দায়িত্ব আউটসোর্স করার বিষয় ভাবা যেতে পারে।

এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার তাৎক্ষণিক পরিদর্শনের জন্য শ্রমিকদের অধিদপ্তর বরাবর সরাসরি অভিযোগ জানানোর কার্যকর ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। যদিও টেলিফোন হটলাইন এবং অনলাইনে পরিদর্শন অধিদপ্তরে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে, বাস্তবে অভিযোগের ভিত্তিতে পরিদর্শনের ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না। সরাসরি অভিযোগের ক্ষেত্রে কতগুলো অভিযোগ কারখানার কাঠামোগত বা আগুনের ঝুঁকিসংক্রান্ত হয় এবং টেলিফোনে বা অনলাইনে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিদর্শন অধিদপ্তর কারখানার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়, সে-বিষয়ক তথ্যও স্পষ্ট নয়। আবার অনলাইনে যে আবেদনের কথা বলা আছে, তার ধরনও শ্রমিকবান্ধব নয়, যেখানে পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ করার সুযোগ নেই—বেশির ভাগ সময়েই যা একজন শ্রমিককে অভিযোগ করতে নিরুৎসাহিত করে।

এর পাশাপাশি কারখানা ও ভবনের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণ, বিদ্যুৎ নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে যথাযথ দায়িত্ব বণ্টন ও কার্যকর সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। যেমন কোনো একটি ভবনে ফায়ার লাইসেন্সের যাবতীয় নথি সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি কলকারখানার পরিদর্শকদেরও অবগত থাকতে হবে, যাতে তা তাঁদের পরিদর্শনের কাজকে সহজ করতে পারে, আবার দ্রুত কোনো ঝুঁকি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও তা সহায়ক হতে পারে।

হাসেম ফুডসের কারখানার মতো এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানে যদি শ্রমিকের প্রাণের ন্যূনতম নিরাপত্তা না থাকে, তবে আরও যে অসংখ্য ছোট কারখানা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশজুড়ে, সেখানে শ্রমিকেরা কতটুকু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর আরও বেশি ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছেন সেসব শ্রমিক, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বাইরে কাজ করেন, যেখানে শ্রম আইন প্রযোজ্যই নয়। সব খাতের শ্রমিকের অন্তত জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে হাসেম ফুডসের কারখানার মতো ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটবেই। একজন শ্রমিকের জীবনও মূল্যহীন নয়—এ নীতিতেই এগোতে হবে এবং সুচিন্তিত ও গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে এগিয়ে চলার পথও চিহ্নিত করা আশু প্রয়োজন।

লেখক : তাসলিমা ইয়াসমীন, সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উত্তরায় প্রাইভেটকারে অপহরণ; ভিডিও ভাইরালের পর গ্রেপ্তার ২

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনায় অপহরণে ব্যবহৃত একটি প্রাইভে...

আমাকে চেয়েছিলো যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী বানাতে: ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত সরকারের সময় তিনবার...

ভালুকায় সৌন্দর্য বাড়াতে ইউএনও’র ‘নিজ খরচে’ সবুজ বিপ্লব

ভালুকা উপজেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও নগর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নি...

কালীগঞ্জে ফিল্মিস্টাইলে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জে...

সড়কহীন ৩৪ কোটি টাকার সেতু

সেতু আছে কিন্তু সংযোগ সড়ক করা হয়নি এমন সেতু ফেনীতে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা