ফিচার

পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে নবস্বপ্ন কাজুবাদাম

নিজস্ব প্রতিনিধি, বান্দরবান : আধুনিক চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছে পাহাড়ি জনপদের অধিবাসীরা।। যার ফলে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সবুজের জনপদে। ফসল উৎপাদনে এসেছে নানা বৈচিত্র্য।

আদা, হলুদ, কলা, জুম, আনারসের পাশাপাশি এবার নতুন করে বৃক্ষ জাতীয় ফসল কাজুবাদাম ও কফি চাষ শুরু হওয়ায় এ জনপদের মানুষদের দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে থাকা পার্বত্য জেলাগুলোতে হাতছানি দিচ্ছে ব্যাপক সম্ভাবনা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে অন্তত ৫ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমি পড়ে রয়েছে। যদি এর ২ লাখ হেক্টর জমিতেও কাজুবাদাম আবাদ করা যায় তা হলে বছরে আয় করা সম্ভব ১০০ কোটি ডলারের বেশি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি পাহাড়ি জমিতে আবাদ করা যেতে পারে কফিও।”

আগামীতে এ দুটি ফসল হতে পারে দেশের অন্যতম রফতানি পণ্য এবং রফতানি আয়ের বড় একটি খাত। আর তাতে পাহাড়ি এলাকার পরিবারদের জন্য তৈরি হবে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পার্বত্য জেলার আবহাওয়া কাজুবাদাম চাষের উপযোগী। একটু যত্নবান হলেই অর্গানিক কাজুবাদাম উৎপাদন সম্ভব। বীজ থেকে পাওয়া বাদামটি সুস্বাদু ও পুষ্টি গুণে ভরপুর।

ফসলের ওপরের অংশের ফল থেকে জুস, ভিনিগার এবং এ্যালকোহল তৈরি হয়। আর খোলস তৈলশিল্প কাজে মূল্যবান দ্রব্য। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশে এখনও সেভাবে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রক্রিয়াজাতকরণের যন্ত্রপাতি নেই, যাতে পোস্ট প্রসেসিংয়ের কাজ করা যায়। তা ছাড়া সংরক্ষণ প্রক্রিয়াও কেউ ঠিকমতো জানেন না। এটি এমন একটি ফল, যা কাঁচা বেশি খাওয়া যায় না।

আবার ফলটি হয় দুই স্তরের। ওপরের অংশটুকু মোটা। নিচের অংশে বাদাম। এর ভেতরে এক ধরনের আঠাজাতীয় পদার্থ থাকে, যা মুখে বা হাতে লাগলে চর্মরোগ হতে পারে। আবার ওপরের অংশটি প্রসেস করতে পারলে প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া সম্ভব।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানা যায়, বৃক্ষ জাতীয় ফসলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজুবাদামের অবস্থান তৃতীয়। বর্তমানে বিশ্বে মোট কাজুবাদাম উৎপাদন হয় ৫৯ লাখ ৩০ হাজার টন। এর বাজার রয়েছে ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই দখল করে রেখেছে ৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের বাজার।

কিন্তু দেশটিতে কাজুবাদাম উৎপাদিত হয় মাত্র ৫ লাখ টন। আর ১৫ লাখ টন কাঁচা পণ্য অন্য দেশ থেকে এনে রফতানির জন্য প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্ববাজারে শীর্ষে অবস্থান করছে ভিয়েতনাম। অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ৯১৬ টন কাজুবাদামের ফলন হয়েছিল। সেটা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩২৩ টনে। অর্থাৎ ৩ বছরের ব্যবধানে ফলন বেড়েছে ৩২ শতাংশ।

এদিকে কাজুবাদামের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ খাতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ জন্য নেওয়া হয়েছে নানামুখী কর্ম পরিকল্পনা। এর মধ্যে চারা বিতরণ, প্রশিক্ষণ দেওয়া, কৃষি গ্রুপ তৈরি, গবেষণাকেন্দ্রগুলোতে বাগান তৈরি করা, নতুন জাত উদ্ভাবনসহ নানা উদ্যোগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে আলাদা একটি প্রকল্পও তৈরি করা হয়েছে।

ফলে পার্বত্য জেলাগুলোতে আগের চেয়ে বেড়েছে কাজুবাদাম চাষ। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বান্দরবানে, ১ হাজার ৭৯৭ হেক্টর জমিতে। পার্বত্যাঞ্চল, বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজুবাদাম চাষের প্রক্রিয়া বাড়ানোর পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণের নানা উদ্যোগও গ্রহণ করেছে সরকার।

সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, ৩ দশক আগে পার্বত্য এলাকায় কৃষকের উন্নয়নের জন্য অন্যান্য ফলের সঙ্গে কাজুবাদামের চারা সরবরাহ করা হয়। সময়ের হাত ধরে গাছগুলো বড় হয়ে ফল দিতে থাকে। কিন্তু কাজুবাদাম বিক্রি, বাজারজাত বা প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা ছিল না। শুধু রাঙামাটিতে দেশীয় পদ্ধতিতে স্বল্প কিছু কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করা যেত।

সেই অঞ্চলের কৃষকরা কেটে ফেলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও উদ্যান উন্নয়ন বিভাগের (কৃষি সম্প্রসারণ) সমন্বয়ে দেওয়া মূল্যবান সেই গাছ। তবে আশার কথা হলো বর্তমানে কাজুবাদামের জাত উন্নয়নে কাজ করছে খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের রাইখালী পাহাড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্র। দেশি-বিদেশি চারা নিয়ে এ কেন্দ্রে চলছে গবেষণা কার্যক্রম।

কাজুবাদামের বর্তমান অবস্থান নিয়ে কথা হয় রাঙামাটির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, তাদের কেন্দ্রে তিনটি মাতৃ বাগানে ৯০টি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে আনা উন্নত জাতের কিছু গাছও আছে। এগুলোর ওপর এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

বিদেশ থেকে আনা গাছের বাদাম সাইজে বড় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো। মৌসুমে পূর্ণবয়স্ক একটি গাছ থেকে ৫০ থেকে ১০০ কেজির মতো কাজুবাদাম পাওয়া যায় বলে জানান তিনি। কথা হয় খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রাশীদ আহমদের সঙ্গে, ‘কাজুবাদাম গাছে বসন্তে ফুল আসে। বর্ষায় ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক একটি দেশি কাজুবাদাম গাছে ১৫ থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত ফল হয়।

একটি গাছ প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত ফল দিতে পারে। গাছ থেকে সেই ফল সংগ্রহ করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে, ভেজে প্যাকেটজাত করতে হয়। তবে প্রক্রিয়াজতকরণ কারখানা গড়ে না ওঠায় চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন না বলে স্বীকার করেছেন এ কর্মকর্তা।

দেশের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা পাহাড়ে অবস্থিত। আর এসব পাহাড়ে প্রচলিত কৃষি পদ্ধতির পাশাপাশি অপ্রচলিত ফলের চাষাবাদ খুবই লাভজনক বলে জানান আঞ্চলিক কর্মকর্তারা। বিশেষ করে কাজুবাদাম, কফি ও ড্রাগন ফল উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে। বাণিজ্যিকভাবে এসব ফসল উৎপাদন করতে পারলে তা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করা যাবে।

সরেজমিন ঘুরে চাষি ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাজুবাদামের আবাদ বাড়লেও প্রক্রিয়াজাতের ক্ষেত্রে রয়েছে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা। রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও নীলফামারী ছাড়া এখনও সেভাবে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় কাঁচা বাদামই বিক্রি করছেন কৃষক। ফলে কাজুবাদামের সম্ভাবনা শতভাগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ চাষিদের।

অথচ সব এলাকায় প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠলে তৈরি হতো কর্মসংস্থান। বাগান মালিকদের লাভের পরিমাণও কয়েকগুণ বেড়ে যেত বলে মনে করেন চাষিরা। খাগড়াছড়ির চাষি মজিবুর রহমান বলেন, ‘কাজু চাষ খুব সহজ। এর জন্য বিশেষ কিছুই করা প্রয়োজন হয় না। গাছের ফাঁকে ফাঁকে অন্য ফসলও চাষ করা যায়। তবে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কষ্টসাধ্য। এ ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের অঞ্চলে বড় বাগান গড়ে উঠছে না।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, দেশে কাজুবাদাম চাষ জনপ্রিয় করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত বছর কৃষকের মধ্যে ফসলটির ৫০ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কম্বোডিয়া থেকে প্রায় ৫ টন হাইব্রিড কাজুবাদামের বীজ আমদানিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ছয় লাখ চারা উৎপাদন সম্ভব হবে।

পাশাপাশি দেশে যাতে প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সে জন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি শুল্কমুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে আমদানির ওপর শুল্কহার প্রায় ৯০ থেকে নামিয়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশে নিয়ে আসতে সম্মত হয়েছে এনবিআর। ভবিষ্যতে এটিকে একদম শুল্কমুক্ত করে দেওয়া হবে।

সান নিউজ/এসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নোয়াখালীতে ভূমি দুস্যুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন 

নোয়াখালী প্রতিনিধি: নোয়াখালীর কোম...

ফসলের ক্ষতি করে চলছে অবৈধ ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রি

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর):

ভূঞাপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় 

খায়রুল খন্দকার, টাঙ্গাইল: প্রচণ্ড তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ট। নেই...

গরমে বারবার গোসল করা কি ক্ষতিকর?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: বৈশাখের শুরু থে...

আজ শেরে বাংলার ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ অবিভক্ত বাংল...

হিটস্ট্রোকে একদিনেই ৬ জনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রা...

আইনি সেবায় মানবিকতাকেও স্থান দেয়া উচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইনি সেবা প্রদানকালে পুঁথিগত আইন প্রয়োগের...

ভূঞাপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় 

খায়রুল খন্দকার, টাঙ্গাইল: প্রচণ্ড তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ট। নেই...

প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরছেন কাল

নিজস্ব প্রতিবেদক: থাইল্যান্ড সফর শেষে আগামীকাল ব্যাংকক থেকে...

ডিপিএস এসটিএস স্কুলে গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডিপিএস এসটিএস স্কুল ঢাকার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা