ছবি: সংগৃহীত
শিক্ষা

অনিয়মের প্রতিবাদ করায় শিক্ষককে বদলি 

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ: প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম ও অন্য শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্যের প্রতিবাদ করাতে মুন্সীগঞ্জ শহরের আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইব্রাহিম কবিরকে বদলি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: দপ্তরীর বিরুদ্ধে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ

ঐ বিদ্যালয়ে গিয়ে সেখানকার কয়েকজন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়।

শিক্ষক ইব্রাহিম কবির আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর তার বদলির আদেশ হয়। ২০ তারিখ তিনি এ বিদ্যালয় ছাড়েন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের অভিযোগ, ইব্রাহিম কবির বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের বিরোধিতা করেছিলেন এবং প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছিলেন। এ কারণে তাকে বদলি করানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: গুচ্ছের ২২০০ আসনে ভর্তি ৩-৪ অক্টোবর

সরেজমিনে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, শ্রেণির কার্যক্রম চলছে। ১০ টার দিকে প্রভাতি পালার মধ্যাহ্ণ বিরতি শুরু হয়।

এ সময় শিক্ষক ইব্রাহিম কবিরের বদিল হওয়া এবং কোচিং বাণিজ্য নিয়ে কথা হয় কয়েকজন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে। তারা জানান, প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল হক যোগাদানের পর থেকে বিদ্যালয়ে অনিয়মের মাত্রা বেড়ে যায়।

যারা প্রতিবাদ করেছে, তারা তার চক্ষুশুল হয়েছেন। যারা প্রধান শিক্ষকের পক্ষে ছিলেন, তারা হাজার অন্যায় করেও তার প্রিয়জন হয়েছেন। সরকার শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য নিষেধ করেছেন। অথচ অনেক শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের প্রশ্রয়ে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: ঢাবিতে অধ্যাপকের পদাবনতি

তারা দুর্নীতি, কোচিং বাণিজ্য এবং প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন অনিয়ম করে যাচ্ছিলো। তাদের মধ্যে বেপরোয়া ছিলেন বিদ্যালয়ের ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক মনোরঞ্জন ধর। বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র নামে একটি কোচিং সেন্টার ছিল তার। প্রধান শিক্ষক সবার বিষয়ে সব জানতেন।

তবে নিজের সমস্যাগুলো ঢেকে রাখতে মিলেমিশে চলতেন। এগুলোর প্রতিবাদ করতেন শিক্ষক ইব্রাহিম। যার জন্য তাকে বদলি করান প্রধান শিক্ষক।

বদলি হওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষক ইব্রাহিম কবিরের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট আনোয়ারুল হক প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তখন থেকে তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস আবাসিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করছেন।

আরও পড়ুন: আইইএলটিএস ওয়ান স্কিল রিটেক চালু

অথচ নিয়ম রয়েছে হোস্টেল ব্যবহার করলে মূল বেতনের ৫ ভাগ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। পরিক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফি থেকে টাকা বেশি আদায় করাতেন।

বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিক্ষায় সম্মানি হিসেবে ৩২ ভাগ নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি ৫০-৫৫ ভাগ নিয়ে নিতেন। নিজের স্বার্থে সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক দিয়ে এসএসসির ইংরেজি খাতার মূল্যায়ন করাতেন।

২০১৯ সালের জেএসসি ও ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় তার ছেলে অংশ নেন। সে সময় ছেলেকে সুবিধা দিতে কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। এগুলোর প্রতিবাদ করেছিলাম।

তিনি আরও জানান, বিদ্যালয়ে সেচ্ছাচারীভাবে কোচিং বাণিজ্য করছিলেন মনোরঞ্জন ধর। তিনি বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করতেন। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করার জন্য প্রধান শিক্ষক আমাকে বদলি করিয়েছেন।

আরও পড়ুন: ১৫ দিনেও কার্যকর হয়নি নির্ধারিত দাম

শিক্ষার্থীরা বলেন, ইব্রাহিম স্যার ভালো মানুষ এবং ভালো শিক্ষক। তাকে প্রধান শিক্ষকসহ কয়েক জন শিক্ষক যোগ সাজেশ করে কৌশলে সরিয়ে দিয়েছেন। তাকে আবারও এ বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা দরকার।

বিদ্যালয়টির প্রভাতি পালার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক রুবিয়া আক্তার বলেন, ইব্রাহিম স্যার প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। তিনি অন্যায় দেখলে কাউকে ছাড় দিতেন না। মুখের উপরেই প্রতিবাদ করতেন। আমাকেও ছাড় দেননি।

তিনি কোচিং বাণিজ্যের বিরোধিতা করতেন। কারো অনিয়ম পেলে সেটা নিয়ে প্রতিবাদ করতেন। প্রধান শিক্ষককেও ছাড় দেননি। দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করেছি। তাকে অন্যায় করতে দেখিনি। তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগও শুনিনি।

আরও পড়ুন: সংসদ সদস্য আব্দুস সাত্তার আর নেই

তিনি আরও বলেন, প্রতিবাদী হওয়ার কারণে তাকে বদলি করা হতে পারে। কেউ মুখ ফুটে না বললেও ইব্রাহিম স্যারের বদলিতে অনেক শিক্ষক কষ্ট পেয়েছেন।

জানতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকেতেই তিনি সাংবাদিক আসার বিষয়টি বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কথা বলতে চাইলে তিনি চেয়ারে বসেন।

এ সময় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে ২ মিনিট কথা বলতে চাওয়া হলে প্রধান শিক্ষক বলেন, সময় নেই, তিনি ঢাকায় যাবেন। পরে ফোনে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ফোনেও কথা বলা যাবে না।

আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর

বিদ্যালয়টি ১৮৯২ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে দুই পালায় পাঠদান করানো হয়। প্রায় ১৮০০ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এটি ফলাফলের দিক থেকে জেলার নাম করা একটি প্রতিষ্ঠান।

এ বছর ফলাফলের দিক থেকে জেলা পর্যায়ে চতুর্থ এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিকে থেকে প্রথম হয়েছে। বিদ্যালয়ের অনিয়ম ও অনিয়মের প্রতিবাদ করায় শিক্ষককে বদলি করা নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন বিদ্যালয়টির অন্য শিক্ষকরাও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষক বলেন, ইব্রাহিম স্যারদের মত শিক্ষকদের জন্য এ বিদ্যালয়ের সুনাম যুগযুগ ধরে টিকে আছে। কয়েকজন লোভী কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত শিক্ষক এবং তাদের প্রশ্রয়দাতাদের জন্য সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

আরও পড়ুন: সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত

মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারুক মিয়ার। তার মেয়ে হুমায়রা ফারুক এ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। শিক্ষক মনোরঞ্জন ধরের কাছে প্রাইভেট না পড়ায় তাকে ফেল করানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সহকারী অধ্যাপক ফারুক মিয়া বলেন, হুমায়রার শ্রেণি রোল চার। সে খুব মেধাবী শিক্ষার্থী। হুমায়রা নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় মনোরঞ্জন স্যারের কাছে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি পড়তো। দশম শ্রেণীতে ওঠার পর তার কাছে আর পড়তে যায়নি। এ কারণে হুমায়রাকে প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় ফিজিক্স ফেল করানো হয়েছে। অথচ অন্য সব বিষয়ে এ+ পেয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে মেয়েরা এই শিক্ষকের কোচিংয়ে না পড়েছে অথবা তার কাছে আগে পড়েছিল এখন পড়ে না, তাদেরকে বাধ্যতামূলক ফেল করানো হয়েছে। যারা তার কাছে পড়েছে, যাদের রোল ষাটের ওপরে, তাদের বিভিন্ন কায়দায় পাশ করানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূল হবে

এসবের পেছনে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকও রয়েছেন। আমরাও শিক্ষক। শিক্ষক হয়ে সামন্য স্বার্থের জন্য তারা কিভাবে এটা করেন, জানি না। তাদের সম্পূর্ণ উল্টো ছিলেন ইব্রাহিম স্যার।

শুধু হুমায়রা নয়, এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন আরো অনেক শিক্ষার্থী। তাদের কয়েকজন অভিভাবক নিলুফা আক্তার, পলি বেগমসহ অন্যদের দাবি, মনোরঞ্জন স্যারের কাছে না পড়লে মেয়েদের নানাভাবে হয়রানি করা হতো। ক্লাসে অপমান করা হতো। ফেল করানো হতো।

বাড়িতে ফোন করে উল্টাপাল্টা কথা বলতেন। বাচ্চারা বাড়ি ফিরে কান্না করতো। কয়েক মাস আগে প্রধান শিক্ষককে বলেছিলাম, তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। ইব্রাহিম স্যার এসবের প্রতিবাদ করতেন। যার জন্য তাকে মুন্সীগঞ্জ থেকে সারতে হলো। অথচ যারা অপরাধী, তারা বহাল তবিয়তে রইলো।

আরও পড়ুন: সাগরে বৈরী আবহাওয়া, হতাশ মৎস্যজীবিরা

অভিযোগের বিষয়ে মনোরঞ্জ ধর বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার একটিও সত্যি নয়। আমাকে উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে ফাঁসানোর জন্য এমনটা করা হচ্ছে। এর আগেও আমার সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমনটা করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শারমিন আরা বলেন, শিক্ষার্থীদের একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা স্কুলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।

শিক্ষার্থীদের দাবি ও অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এছাড়া অন্য কোনো নতুন অভিযোগ আসলে সেগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিক্ষক ইব্রাহিমের বদলি বাতিল করে তাকে পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার দাবিতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মূল ফটকে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে ওই শিক্ষককে বদলির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানায় তারা।

সান নিউজ/এনজে

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উত্তরায় প্রাইভেটকারে অপহরণ; ভিডিও ভাইরালের পর গ্রেপ্তার ২

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনায় অপহরণে ব্যবহৃত একটি প্রাইভে...

আমাকে চেয়েছিলো যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী বানাতে: ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত সরকারের সময় তিনবার...

ভালুকায় সৌন্দর্য বাড়াতে ইউএনও’র ‘নিজ খরচে’ সবুজ বিপ্লব

ভালুকা উপজেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও নগর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নি...

কালীগঞ্জে ফিল্মিস্টাইলে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জে...

সড়কহীন ৩৪ কোটি টাকার সেতু

সেতু আছে কিন্তু সংযোগ সড়ক করা হয়নি এমন সেতু ফেনীতে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা