অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত-ফাইল ছবি
মতামত
প্রতিবেশ

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কার্যকর হতে হবে

ড. আইনুন নিশাত

শনিবার, ৩ জুলাই এ বছরের সম্ভাব্য বন্যা বিষয়ে লিখতে বসেছি। গত পাঁচ-ছয় দিন ধরে কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর ফোন পাচ্ছি। এবার বন্যার প্রকোপ কী রকম হতে পারে সে বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছেন। তাদের কাছে খবর আছে ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়ছে। সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ এসব এলাকায় পানি বেশ বেড়েছে এবং নদীর পাড় ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

তিস্তা, ধরলা এবং দুধকুমারের পানি বাড়ছে। সিলেট অঞ্চলের কিছু নদীর পানিও বেড়ে চলেছে। তারা আরও বললেন, ভারতের বিহার, আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণেই তারা ধারণা করছেন, কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে বন্যা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন খবরের কাগজে গত দুই-তিন দিন ধরে উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে।

তাদের ফোন পাওয়ার পরপরই পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। তাদের প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদনদীগুলোর অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করলাম। পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা বিষয়ে সাধারণত পাঁচ দিন এবং দশ দিনের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। পাঁচ দিনের পূর্বাভাস সম্পর্কে তাদের দক্ষতা ভালো এবং পূর্বাভাসটি মোটামুটি ভবিষ্যতের সঙ্গে মিলে যায়। তাদের দশ দিনের পূর্বাভাসকে ইন্ডিকেটিভ বা নির্দেশমূলক বলা যেতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য এবং তাদের পূর্বাভাসকে কেন্দ্রে করেই বন্যা সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা দিচ্ছি- তিন-চার দিন আগে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বন্যা বিষয়ক একটি তথ্যকেন্দ্র খুলেছে। অর্থাৎ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বন্যার বিষয়ে সজাগ আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ও বন্যার আশঙ্কাযুক্ত এলাকাগুলোতে তদারকি বাড়িয়েছে।

ব্রহ্মপুত্রের পানি গত কয়েকদিন ধরেই বাড়ছে। অন্য যে কোনো বছরের মতো এ বছরও মে মাসের মাঝামাঝি থেকে নদীর পানি বাড়ছে। তবে এখনও বিপদসীমার ৫-৬ ফুট নিচেই রয়েছে। কিন্তু পূর্বাভাস ধারণা দিচ্ছে জুলাই মাসের ৬-৭ তারিখের দিকে তা বিপদসীমা অতিক্রম করবে এবং বেশ বাড়বে। অন্যদিকে তিস্তার পানি বাড়ছে এবং তা বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ধরলার অবস্থাও তাই। তবে প্রাকৃতিকভাবে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না।

এখন বিপদসীমা শব্দটি বোঝা দরকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড বিপদসীমার একটি সংজ্ঞা ব্যবহার করে। তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী- যেখানে নদীর তীর বরাবর বাঁধ নেই, সেখানে নদীর পানি যদি এমন উচ্চতায় পৌঁছায়, যার ফলে নদীর পানি পাড় উপচে ওই স্থানের আশপাশের ঘরবাড়ি এবং শস্য বা ফসল ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাহলে পানির সেই উচ্চতাকে বিপদসীমা বলা হয়।

অর্থাৎ নদীর পানি উপচে প্লাবন ভূমিতে ঢুকলেই বিপদসীমায় পৌঁছেছে এটা বলা যাবে না। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হতে হবে। অন্যদিকে যেসব নদীনদীর তীর বরাবর বাঁধ আছে সেখানে পানির যে স্তরের কথা বিবেচনা করে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেই উচ্চতাই বিপদসীমা।

খবরের কাগজে পড়লাম- শেরপুর ও জামালপুর এলাকায় নিচু জায়গা ডুবে গেছে। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ এখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী কোনো বাঁধ বা অবকাঠামো নেই। কাজেই জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এই তিন মাস ওই এলাকাগুলো নদীর পানিতে ডুবে যেতে পারে।

খবরের কাগজে আরও পড়লাম, সিলেট অঞ্চলে হাওরগুলোতে পানি ঢুকেছে এবং নিচু জায়গাগুলো ডুবে গেছে। এটাও খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ওই এলাকার ডুবন্ত বাঁধগুলোও ডুবে যাবে। এখন মাঠে অর্থাৎ হাওরগুলোতে কোনো ফসল থাকার কথা নয় এবং কোনো চিন্তার কারণ হওয়ারও কথা নয়।

নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের নদীগুলোতে বাঁধ ভেঙে ভেতরে পানি ঢুকে বন্যার অবস্থা ঘটিয়েছে। তবে কোনো এলাকায় বাঁধ উপচে পানি ঢোকেনি। একই ঘটনা ঘটেছে রংপুর ও কুড়িগ্রাম অঞ্চলে। কিছু কিছু জায়গায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে।

অল্প কিছু এলাকা ছাড়া দেশের সর্বত্রই বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধ আছে। কাজেই বাঁধ ঠিকমতো টিকে থাকলে সংরক্ষিত এলাকায় পানি ঢোকার কথা নয়। প্রধানত দুই কারণে বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়। প্রথমত, নদীভাঙনের ফলে পানির প্রবাহ বাঁধকে সরাসরি আঘাত করতে পারে এবং এর ফলে বাঁধ ভাঙতে পারে।

এতে প্রযুক্তি হিসেবে বাঁধকে দোষ দেওয়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে নদীভাঙন ঠেকাতে হবে। আগেকার দিনে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব হতো না। এখন সঠিকভাবে ডিজাইন করে এবং ডিজাইন অনুযায়ী যথাযথভাবে তা নির্মাণ করে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব। এ কাজে সরকার অর্থায়নও করছে। আর বাঁধ ভাঙার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পানির চাপে তা ভেঙে যায়। এটি খুবই দুঃখজনক।

আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশের নদীগুলোকে চারটি জোনে ভাগ করি। এ চারটি জোন হলো- ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা, গঙ্গা অববাহিকা, মেঘনা অববাহিকা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল। গঙ্গা অববাহিকায় বছরের এ সময় স্বাভাবিকভাবে পানির স্তর বিপদসীমার বেশ নিচে থাকে এবং এ বছরও তাই আছে। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ এবং আগস্ট মাসের শুরুর দিকে এই এলাকার দিকে চোখ রাখতে হবে।

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বাভাবিকভাবে জুলাইয়ের প্রথম থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পানির স্তর বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এবারও তাই হচ্ছে। মেঘনা অববাহিকাতেও পানি বাড়ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিটি নদীর ব্যবহার আলাদাভাবে বুঝে নিতে হবে।

এখানে বলতে হয় যে, বিপদসীমা অতিক্রম করলেই বাঁধ টপকে পানি ঢোকার কথা নয়। কারণ ডিজাইনের সময় বাঁধটির জন্য যে উচ্চতা ধরা হয় তাতে বাঁধটি যথেষ্ট উঁচু হয়। ডিজাইন অনুযায়ী বাঁধটি নির্মিত হলে ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ থাকলে পানির চাপে তা 'ফেইল' করার কথা নয়। বাঁধ টপকে পানি ঢুকেছে তার তেমন নজির নেই।

প্রায় প্রতিবছরই জুলাই-আগস্ট মাসে দেশজুড়ে বন্যার খবর বের হয়। কোনো জায়গা পানিতে ডুবে গেলেই কি তা বন্যা? এই বিষয়টি বোঝা দরকার। স্বাভাবিক কারণে পানি নদীর কানায় কানায় পূর্ণ হলে চরগুলো ডুবে যাবে, এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই চর ডুবে গেলেই তাকে বন্যা বলা হবে, এই অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে।

বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে যে বন্যা হয় তা প্রতিহত করতে হবে। সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে পানি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিকে বাঁধ ব্যবস্থাপনায় জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ও একইভাবে স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছে। পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে জনমানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে সংশ্নিষ্ট স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দিতে হবে।

প্রাকৃতিক কারণে জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস- এই চার মাস বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল পানিতে ডুবে যেতে পারে। এসব এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী অবকাঠামোর ভিত্তিতে বন্যা বিষয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। চরাঞ্চল ডুবে গেলে সেটাকে বন্যা বলার কোনো কারণ নেই। একইভাবে হাওরাঞ্চল মে মাসেই ডুবে যেতে পারে এটাও স্বাভাবিক।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, এটাকে মনে রেখে ফসল লাগানোর সময়ের কিছুটা পরিবর্তন করতে হতে পারে কিংবা স্থানভেদে আগাম ফসলের কথা ভাবা যেতে পারে অথবা দেরি করে ফসল লাগাতে হতে পারে। এ বছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে হাওরাঞ্চলে ফসল কাটা শুরু করা হয়েছিল এবং এপ্রিল নাগাদ ফসল কাটা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

এর কারণ উপযুক্ত প্রজাতির ধান লাগানোর জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। অন্যদিকে দেশের যেসব এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধ নেই যেমন- জামালপুর, শেরপুর কিংবা শরীয়তপুর, মাদারীপুর- সেখানে দেরি করে আমন লাগানোর কথা ভাবা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধগুলো কার্যকর হতে হবে।

পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সান নিউজ/এমএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

প্রস্তুতি ম্যাচের সূচি প্রকাশ

স্পোর্টস ডেস্ক : আসন্ন আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল আস...

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ শনিবার (১৮মে) বেশ কিছু খেল...

কর্মস্থলে না এসেও বেতন তোলেন শিক্ষক

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

মেঘনা নদীতে পাঙ্গাশ রক্ষায় অবৈধ চাই ধ্বংস 

ভোলা প্রতিনিধি: ভোলায় মেঘনা নদী থ...

মুন্সীগঞ্জে ভাসমান মরদেহ উদ্ধার

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মধ্য কোটগাঁ...

ওএমএস বিতরণে গাফলতি হলে ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক: খাদ্যমন্ত্রী সা...

পটল কেন উপকারী?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: পটল আমাদের দেশের পরিচিত একটি সবজি, যা খেতে...

মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে

জেলা প্রতিনিধি: বিচারের আগে মিডিয...

হোয়াটসঅ্যাপে আসছে পরিবর্তন

টেকলাইফ ডেস্ক: জনপ্রিয় যোগাযোগ মা...

মঙ্গলবার ১৫৭ উপজেলায় সাধারণ ছুটি 

নিজস্ব প্রতিবেদক: ষষ্ঠ উপজেলা পরি...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা