প্রেমের আগমন নীরবেই গেড়ে বসে মস্তিষ্কে (ছবি: সংগৃহীত)
মতামত

প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে

জামিউর রহমান লেমন: বিবর্তনের পথ ধরেই সত্তর হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটে। হোমো স্যাপিয়েন্স নামে তাকে অভিহিত করেন বিজ্ঞানীরা, যার বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। এই মানুষের একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো মস্তিষ্ক।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই মস্তিষ্ক থেকেই ভালোবাসার উৎপত্তি। তারা মনে করেন, মন বা হৃদয় বলে কোনো কিছুই প্রেম সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে না। ভালোবাসা বা প্রেম হলো মনের কল্পনা অতিক্রমকারী মস্তিষ্কজাত, যা দৈহিক চাহিদার ফলিত রূপ এবং জৈবিক তাড়না মাত্র।

প্রেমের প্রথম স্তর সম্পর্কে গবেষক হেলেন ফিসার বলেছেন, যখন কাউকে ভালো লাগে, তখন তাকে ভালোবাসার আগ্রহ বা ইচ্ছা থেকে ছেলেদের ক্ষেত্রে টেসট্রোন ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন হরমন নিঃসৃত হয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদিও কমবেশি হরমন সম্পর্কিত বিষয়। হরমনই নির্ধারণ করে কেন ও কখন আপনি প্রেমে পড়বেন। তাই চেতনে-অবচেতনে মানুষ প্রেমে পড়ে।

প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে। প্রেমের আগমন নীরবেই গেড়ে বসে মস্তিষ্কে। একজন অন্যজনকে কাছে টানার আগ্রহে দিবানিশি ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রেম আসলে কী, এর সঠিক ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দাঁড় করানো সত্যিই কঠিন। কেউ বলে, প্রেমের আরেক নাম জীবন। কেউ বলে, প্রেমের নাম বেদনা। কেউ বলে, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই। ভাববিলাসীদের মতে, স্বর্গ হতে আসে প্রেম, স্বর্গে যায় চলে।

আসলে যে যাই বলুক না কেন, এই জগতে জীবনে চলার পথে একবার প্রেমে পড়েননি এমন মানুষ খুব একটা নেই বললেই চলে। জীবনে প্রেম একবার নীরবেই হানা দেয়-এটাই হলো আসল কথা। পৃথিবী শুরুর ঘটনা থেকে আদম-হাওয়ার প্রেম যদি বিস্তার লাভ না করত, তাহলে কি এই বিশ্বজগত সৃষ্টি হতো! এত জাতপাতের সৃষ্টি-বিস্তারের প্রয়োজন ছিল কি?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে এই শতকের গবেষকরা এখনো নাজেহাল। ইউসুফ-জুলেখা, শিরী-ফরহাদ, চণ্ডিদাস-রজকিনি, মমতাজ-শাহজাহানসহ হাল আমলের দেশ-বিদেশের অনেক প্রেমকাহিনি আমাদের জানা, তবুও বর্তমান সভ্য সমাজে প্রেম যেন নিষিদ্ধ কোনো বিষয়! যদিও আধুনিক প্রজন্ম এসব মানতে নারাজ, তাদের কথা হচ্ছে-প্রেম শাশ্বত, প্রেম অমর, প্রেম মানবজনমের অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।

ষাটের দশকে আমার জন্ম একটি রক্ষণশীল পরিবারে। তবে গোঁড়ামি ছিল না। এ ধরনের পরিবারে সবকিছুতেই থাকে রাখঢাক। বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের চোখে চোখে রাখার একটা প্রবণতা। অমুকের সঙ্গে মিশতে মানা, অমুকের সঙ্গে ঘোরা যাবে না। ছেলেদের থাকবে ছেলেবন্ধু আর মেয়েদের থাকবে মেয়েবন্ধু। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে বাড়িতে। একেবারে কড়া ফর্দ। বাবা-মায়ের কড়া শাসন।

তবুও সেই শাসনের ফাঁক গলিয়ে কখন যে প্রেম নীরবে হানা দেয়, বসতি গাড়ে মস্তিষ্কে, বাবা-মা তা টেরই পেতেন না। তখন অবশ্য প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়ে পালানোর প্রবণতা ছিল। এখন তেমনটি নেই। ছেলে তার পছন্দের মেয়েটির হাত ধরে সটান পিতৃগৃহে ফেরে। নির্লজ্জের মতো বলে, ‘এই যে তোমার বউমাকে এনেছি।’ আর মেয়েও মা-বাবার মুখের ওপরই সিদ্ধান্ত ছুড়ে মারে-‘ব্যবস্থা করো, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’ তার মানেই হলো নীরবে হানা দেওয়া প্রেম সরবে চিৎকার করতে থাকে জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ বলে।

গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা মুঙ্গেশকর গেয়েছিলেন তার বিখ্যাত গান ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। এর চারটি শব্দই পুনঃপুনঃ গবেষণার দাবি রাখে বলে মনে করি। প্রেম আসলে কী, কোথায় এর অবস্থান, কোথায়বা যায় চলে, মানবজীবনে প্রেম কি একবারই আসে, আর নীরবে আসার কারণটা কী? পরিণত বয়সে এসে এখনো এসব বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

সে যাই হোক, লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া এই গানটি বুঝে অথবা না বুঝেই ছোটবেলায় আমাকে নাড়া দিয়েছিল। যখন প্রথম হারমোনিয়ামে গান তুলতে শিখি, তখন যে গানটি বাজাতে শিখেছিলাম সেটা হলো ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। স্কুলে পড়ুয়া সদ্য কিশোর একটি ছেলের কণ্ঠে গানটি শুনে ডলি আপা, মুন্নি আপা, রেহেনা আপার মুচকি হাসি আজও মনে পড়ে। সময় পেলেই সিঙ্গেল রিডের হারমোনিয়ামে গানটি গাইতে ভালো লাগত।

পাড়ার রঞ্জু বুবুর বিয়েতে গ্রামোফোনের রেকর্ডে গানটি যখন বাজত, তখন কান পেতে শুনতাম। আমার গায়কীতে কোথাও ভুল আছে কিনা, মিলিয়ে নিতাম। একদিন যখন বারান্দায় বসে লিওন, বিউটি, মিনু, আজাদের সঙ্গে কোরাসে গানটি গাচ্ছি, তখন রোজী আপা হাসতে হাসতে বললেন, দাদু ভাই এটা তো মেয়েদের গান, তুমি গাও কেন? গান যে মেয়েদের হয় এটা আমার প্রথম শোনা।

রোজী আপার কথায় ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম। আর তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, ছেলে ও মেয়ের পৃথক দুটি সত্তা রয়েছে। এরপর আর ওই গানটি গাওয়া হয়নি। তবে মনে হয় পরিণত বয়সে এসে সেই গানটি এখনো সবার ভালো লাগে, মনের গহিনে আজও হয়তো ঝড় তোলে।

প্রেমের আগমনে মানুষ কবি হয়ে যায়।

প্রেমের আগমনে মানুষ নতুন জীবন ফিরে পায়।

প্রেমের আগমনে মানুষ অবলম্বন খুঁজে পায়।

প্রেমের আগমনে পৃথিবী রঙিন হয়ে যায়।

প্রেমের আগমনে মনের সুকুমারবৃত্তি জাগ্রত হয়।

প্রেমের আগমনে মানুষ স্বর্গের সুখ পায়।

প্রেমের আগমনে মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।

প্রেমের আগমনে জীবন গতিশীল হয়।

প্রেমের আগমনে অচেনাকে চেনা যায়।

প্রেমের আগমনে মানবজনম সার্থক হয়।

যেদিন লতাজী চলে গেলেন, সেই রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার সেই যৌবনদীপ্ত সময়ের মায়াবী কণ্ঠনিঃসৃত সুর কানে বাজছিল-‘ভাগ্যে যা লেখা আছে হায়রে, তারে চিরদিন হবে জানি মানতে, প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। লতাজীর জীবনে প্রেম এসেছিল নীরবে, অসংখ্য ভক্তের প্রেম, যে প্রেম সব সীমানা অতিক্রম করে ভালোবাসার মহিরুহে পরিণত হয়েছে। লতাজী বলেছিলেন, ‘জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ের ওপর কারও হাত নেই, আমি যদি বিয়ে করতাম, আমার পুরো জীবনই অন্যরকম হতো, তবে আমি কোনো দিন একাকিত্ব বোধ করিনি।’

আরও পড়ুন: একুশের চেতনা ও দেশাত্মবোধ

কীভাবে একাকিত্ব বোধ করবেন প্রিয় লতাজী? আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা থাকব; আপনার কণ্ঠনিঃসৃত সুরের বেড়াজালে মগ্ন হয়ে আমৃত্যু আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাব, যে প্রেম শাশ্বত। মানুষ আপনার সুরের বন্দনা করবে, যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

জামিউর রহমান লেমন : কণ্ঠশিল্পী ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা

সাননিউজ/এমএসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী পান্নার গণসংযোগ

রাজীব চৌধুরী, কেশবপুর : আসন্ন কেশবপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে...

বোয়ালমারীতে স্বর্ণের কারিগরকে কুপিয়ে জখম

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে...

বজ্রপাতের সময় করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক: চলমান তাপপ্রবাহ...

নিজ্জর হত্যায় সন্দেহভাজন ৩ জন গ্রেফতার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কানাডায় বসবাসর...

ইন্দোনেশিয়ায় বন্যা-ভূমিধস, নিহত ১৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইন্দোনেশিয়ার ম...

কেমব্রিজ পরীক্ষায় ডিপিএস শিক্ষার্থীদের সাফল্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি প্রকাশ...

ফরিদপুরে স্টপেজের দাবিতে মানববন্ধন 

বিভাষ দত্ত, ফরিদপুর: ফরিদপুরে রেল...

পাবনায় আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ দিবস পালিত

পাবনা প্রতিনিধি: ‘জলবায়ু স...

অস্ট্রেলিয়া গেলেন বিমানবাহিনী প্রধান

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি সফরে অস্...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা