বাংলাদেশের অর্থনীতি (ছবি: প্রতীকী)
মতামত

মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন ও বাস্তবতা

হোসেন জিল্লুর রহমান: মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ। কিন্তু মধ্যম আয়ের ফাঁদ ডিঙানো কতটা সহজ হবে? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমাদের উন্নয়ন, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন, চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবতা আলোচনাই পরবর্তী প্রয়াস। ৫০ বছর আগে নতুন স্বাধীন দেশে নাগরিক ও পর্যবেক্ষকদের উদ্বেগের বিষয় ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে। আজ পাঁচ দশক পর দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্যোগপ্রবণ এবং ভঙ্গুর দেশ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশের অর্থনীতি যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তা দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অবাক করে দিয়েছে।

বলাবাহুল্য, দেশের অর্থনীতির এই রূপান্তর যেমন রাতারাতি অর্জিত হয়নি; তেমনি একক কোনো গোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় হয়েছে- এমনটিও নয়। তবে পরিবর্তনটা বাস্তবে ঘটেছে এবং সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী দশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর রাজনৈতিক উন্নয়ন একই ধারায় প্রবাহিত হয়নি।

স্বাধীনতার পর রাজনীতির চ্যালেঞ্জ ছিল সে অর্থে কম। তবে দুঃখজনক বিষয় হলেও সত্য, আজকের রাজনৈতিক উন্নয়নে যে ঘাটতি রয়েছে, সেটি একটি একীভূত ও মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্নের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে যেমন ক্ষমতায় জবাবদিহির সংস্কৃতি উঠে যাচ্ছে, তেমনি অযোগ্য লোকদের দায়িত্বশীল আসনে বসানো ও পদ্ধতিগত দুর্নীতিও বাড়ছে।

যা হোক, বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, সেখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, দুর্যোগের সঙ্গে আমাদের বসবাস। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, সেখানে আমাদের বৈশ্বিক স্বীকৃতি বড় অর্জন। খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাশের রূপান্তর বিস্ময়কর। আমাদের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় ফসলের ভূমি কমতে থাকার পরও খাদ্য উৎপাদন তিন গুণ। আমাদের নিরক্ষর কৃষকরাও কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো, প্রত্যন্ত এলাকাও আজ পিছিয়ে না থেকে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

পক্ষান্তরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও তাদের অবদান যোগ হচ্ছে। গ্রামের উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক উভয়ের অবদান রূপান্তরিত হয়ে অর্থনৈতিক গন্তব্য হিসেবে জাতীয় হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এ সময়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে ঘটেছে। যদিও ক্ষমতায়নের দিক থেকে নারী এখনও সংগ্রাম করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের উপস্থিতি ছাত্রদের অনুপাতে সমানই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রীরা এগিয়েও রয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এখন ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অর্থনীতির এই যে রূপান্তর, তাকে যেমন প্রচলিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিরিখে দেখার সুযোগ নেই; তেমনি রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রচারেরও অবকাশ নেই। এখানে সাধারণ মানুষের ভূমিকাই মুখ্য। কৃষকদের বিষয়টি ইতোমধ্যে এসেছে। আমাদের তরুণরা বৈশ্বিক শ্রমবাজারের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। দরিদ্র নারীরাও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। অবসরে যাওয়া মানুষও নতুন উদ্যোগ গড়ে তুলছেন। সুতরাং অর্থনৈতক উন্নয়নে প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

একই সঙ্গে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমাধানকেন্দ্রিক উদ্ভাবনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার পর 'জাতি গঠন' বিষয়টি শুধু অভিজাত অভিধা হিসেবেই থাকেনি, বরং সবার মধ্যেই এটি ছিল জনপ্রিয় বিষয়। সে সময় দেশের এনজিওগুলোর আবির্ভাব ঘটে। তবে উদ্ভাবনের অনুসন্ধান শুধু এনজিও খাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ, গ্রাম-গঞ্জের সড়ক, সামাজিক বনায়ন, আর্থিক লেনদেন, ফসলের বৈচিত্র্য, সৌর বিদ্যুৎ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদ্ভাবন প্রয়োজনে হয়েছে এবং তা চলমান।

পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজনীতির ভূমিকাও অনুল্লেখযোগ্য নয়। সাধারণ রাজনীতি নয়, বরং স্থানীয় ও জাতীয় উভয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতাপূর্ণ রাজনীতি এটা করেছিল, যেটি ১৯৯০ থেকে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। এটা সত্য, এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এটি রাজনৈতিক নবায়নের অন্যতম বাস্তবতা নিশ্চিত করেছিল। যেখানে আনুষ্ঠানিক জবাবদিহির প্রক্রিয়াগুলো এখনও তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি, সেখানে এ প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতামূলক রাজনীতিই জবাবদিহির বলতে গেলে একমাত্র নিয়ামক হিসেবে কাজ করছিল। বিশেষ করে, নব্বইয়ের দশকে যখন ভোটের রাজনীতি ফিরে এসেছে তখনই আমরা দেখেছি প্রবৃদ্ধির ধারা ত্বরান্বিত হয়েছে।

কিছু প্রাতিষ্ঠানিক নীতিও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। আশির দশকের ঔষধনীতি, নব্বইয়ের দশকে ব্যাংক খাতের সংস্কার, এর পর টেলিযোগাযোগ ও ডিজিটাল খাতের উত্থান, মোবাইল ব্যাংকিংসহ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন এমডিজি লক্ষ্যমাত্রার সফলতায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সামাজিক উদ্যোগও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিকরণ ও কৃষির আধুনিকায়নে ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশের ৫০ বছরের পরিক্রমার দুই দশক ছিল গড়ার ভিত্তি স্থাপনের সময়, যে সময়কে আমরা উন্নয়নের জন্য 'টার্নিং পয়েন্ট'ও বলতে পরি। এ সময়ে রাজনীতি ও অর্থনীতি উন্নয়নে বিশেষ রূপে এগিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো নব্বইয়ের দশক। এ দশকে বিশেষ চারটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, যার কারণে আমরা একে 'টার্নিং পয়েন্ট' বলছি। সেগুলো হলো- বাজার অর্থনীতি ও প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের প্রসার, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনীতি, শিল্পোদ্যোগের শক্তিশালী নীতি গ্রহণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলকে সঙ্গে নিয়ে গতিশীল সামাজিক খাতের বিকাশ। এসব কারণে যেমন এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে, তেমনি 'ব্রেইন ড্রেইন' থেকে 'ব্রেইন গেইন'-এ রূপান্তর ঘটেছে।

২০১০-এর দশকটি এক বিপরীতমুখী 'টার্নিং পয়েন্ট' দেখেছে। যেখানে প্রবৃদ্ধির গতি আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ আরও এগিয়েছে। যদিও এ সময়ে তিনটি বিপরীতমুখী ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে আয়-বৈষম্য বেড়েছে। ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের বৈষম্য স্টম্ফীত হয়েছে; কর্মসংস্থানের সংকট গভীরতর হয়েছে, যেখানে এক-তৃতীয়াংশ তরুণের হয় চাকরি নেই, নয়তো শিক্ষা নেই কিংবা নেই প্রশিক্ষণ।

দারিদ্র্য বিমোচনের গতি শ্নথ হয়েছে। প্রতিযোগী পুঁজিবাদ 'ক্রনি ক্যাপিটালিজম'-এর পথ প্রশস্ত করেছে। এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার তথা এনরোলমেন্ট সন্তোষজনক হলেও সেখানে গুণগত শিক্ষার অভাব রয়েছে। মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের ও পরিবারের টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি পেতে সংগ্রাম করছে। এমনকি নারী উন্নয়নে পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সহিংসতা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। দুর্বল সুশাসনের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এ সময় বেড়েছে।

বাংলাদেশের ৫০ বছরের পরিক্রমা এভাবে সংকটের দিক থেকে ডিকেন্সিয়ান রূপ লাভ করেছে। উন্নয়নের রূপান্তর নিঃসন্দেহে সত্য, গভীর ও বাস্তব। কিন্তু ভবিষ্যৎ সে অর্থে কম অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পথ চ্যালেঞ্জপূর্ণ। দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনের উদাহরণ আমাদের জন্য সতর্কবার্তা, যারা মধ্যম আয়ের ফাঁদ উতরাতে পারেনি।

বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার পরবর্তী পর্যায়ে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বেসরকারি খাতের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা এ ভূমিকা কতটা কার্যকর থাকবে, তার উত্তর দেয়। এর আগে আমাদের রাষ্ট্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারি খাত এবং স্বচালিত বেসরকারি খাত ছিল। এখন একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতা প্রমাণ করার চেয়ে ক্ষমতার নৈকট্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

শুধু ক্ষমতার নৈকট্যই নয়; আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতার উচ্চ সারণিতে অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বেসরকারি খাতের পদ্ধতিগত অগ্রাধিকারগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার প্রতি কম এবং ক্ষমতাসীন শক্তির সমর্থন থেকে সুবিধা নেওয়ার দিকে বেশি মনোযোগী বলে মনে হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব্ব ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতির লাভজনক ক্ষেত্রগুলো সিন্ডিকেট বা মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হলো, অস্পষ্ট 'বেসরকারি খাত'-এর স্বার্থের আপাত সুবিধার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে উপেক্ষা করা। এটি কি একটি নতুন টার্নিং পয়েন্ট?

আরও পড়ুন: সিনহা হত্যার বিচার ও আইনের শাসন

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সূচকে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে প্রাতিষ্ঠানিক, লজিস্টিকস, দক্ষতা, শ্রমবাজারের সক্ষমতা, প্রাযুক্তিক প্রস্তুতি এবং আইনের শাসনের দিক থেকে দুর্বলতা স্পষ্ট। সুতরাং মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া কি স্বপ্নই থেকে যাবে? সময়ই তা বলে দেবে।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতিবিদ ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি

সাননিউজ/এমএসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

বোয়ালমারীতে স্বর্ণের কারিগরকে কুপিয়ে জখম

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে...

নিজ্জর হত্যায় সন্দেহভাজন ৩ জন গ্রেফতার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কানাডায় বসবাসর...

বজ্রপাতের সময় করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক: চলমান তাপপ্রবাহ...

ইন্দোনেশিয়ায় বন্যা-ভূমিধস, নিহত ১৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইন্দোনেশিয়ার ম...

ভালুকায় পানি ও স্যালাইন বিতরণ

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রচন্ড...

শাহজালালে বন্ধ থাকবে ফ্লাইট ওঠানামা

নিজস্ব প্রতিবেদক: হযরত শাহজালাল আ...

উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী পান্নার গণসংযোগ

রাজীব চৌধুরী, কেশবপুর : আসন্ন কেশবপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে...

লিফট কিনতে ফিনল্যান্ড গেলেন ঢাবির প্রো-ভিসি

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিভিন্ন ভবনের...

লন্ডনে ফের মেয়র হলেন সাদিক খান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাজ্যের র...

ইয়াবাসহ গ্রেফতার ১

জেলা প্রতিনিধি: চট্টগ্রাম জেলায় ক...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা