মতামত

কৃষিবান্ধব হোক পদ্মা সেতু

শিবলী নোমানী: সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সাহিত্যিক এক জ্যেষ্ঠ বন্ধু কিছু দিন আগে পদ্মা সেতুর ব্যাকগ্রাউন্ড যুক্ত একটি ছবি আমাকে ইনবক্স করেন। কৌতুকযুক্ত ছবিতে দেখা যাচ্ছে– ‘একটি রাজনৈতিক দলের মহাসচিব দলীয় প্রধানের কানে কানে জিজ্ঞেস করছেন, ম্যাডাম! পদ্মা সেতু তো হয়ে গেলো। এখন নদী ব্রিজ দিয়ে পার হবো, নাকি নৌকায়? ম্যাডাম কিছুটা চিন্তিত ও বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে বললেন, নৌকাও তো তাদেরই।’ পরে জানলাম– ছবিটি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।

আরও পড়ুন: শিশুশ্রম জাতির জন্য হুমকি স্বরূপ

আসলে বিশেষ একটি দল নয়; দেশ-বিদেশের অনেকেই মনে করেছিলেন নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। খোদ আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় অনেক নেতার মাঝেও তখন দেখা গেছে কানাঘুষা ও সন্দেহের ছাপ। এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারের সাবেক দুই একজন মন্ত্রীও বিস্ময় প্রকাশ করে প্রকাশ্যে এটাকে অবাস্তব বলে মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাও রয়েছেন এর মধ্যে। তাদেরই বা দোষ কী; পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আটকে গেলে পৃথিবীর প্রায় সব দাতা সংস্থাই এটাকে নিজস্ব অর্থায়নে করা একটি অপরিপক্ব আকাশ কুসুম কল্পনা বলে দাবি করে। দৃঢ়চেতা লৌহমানবী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেই অবাস্তব কল্পনাকে বাস্তবে সীমারেখা টেনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের ধারণা পালটে দিয়ে এক গৌরবময় মহাকাব্য রচনা করেছেন। আজ সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান ও আলোকিত। উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় গোটা জাতি। কিন্তু কেন তিনি এতটা একরোখা হয়ে এই সেতু নির্মাণের প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়েছিলেন?

দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মিথ্যা অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করাটা মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেননি তিনি। তিনি এটাকে রাষ্ট্রের জন্য অপমান হিসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি দাতাগোষ্ঠীর বেড়াজাল থেকে দেশকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। সফল পদক্ষেপে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। দূরদর্শী রাজনীতিক হিসেবে তিনি সফল হয়ে বিশ্বকে অবাক বিস্ময়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। ফলে তার পক্ষেই পদ্মা সেতুর চেয়েও বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ সম্ভব হয়েছে।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের ২৯ শতাংশ এলাকার মানুষ রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হলো। দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমেও নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পদ্মার পাড়ে ফেরির অপেক্ষায় থাকা কৃষিজাত পণ্যের মালিক-শ্রমিকরা কিছুক্ষণ পরপর পরখ করতেন পচন ধরেছে কিনা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বা ফেরি জটিলতার সময় আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি কৃষিজাত পণ্য নিয়ে কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ঈদ বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদী পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এছাড়া ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থেকে কেউ আর অ্যাম্বুলেন্সেই লাশ হয়ে বাড়ি ফিরবে না। এখন তার একটি বৈপ্লবিক সমাধান হলো। এডিবির তথ্যানুযায়ী, এই সেতু হওয়ায় প্রতিটি ট্রাক যাতায়াতে ১০ ঘণ্টা সময় কম লাগবে ও বাসে গড়ে দুই ঘণ্টা।

শুধু তাই নয়। ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল জার্মানিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে ধারণা উপস্থাপিত হয় তারও অন্যতম শর্ত একটি রাষ্ট্রের সমষ্টিগত যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে রুটের অংশ হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। শুধু বাংলাদেশের নয়; যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বড় ভূমিকা রাখবে এই পদ্মা সেতু। এই সেতু দেশের জিডিপিতে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে। এককভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ১ শতাংশ। এডিবি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এই প্রকল্প নিয়ে একটি মূল্যায়ন রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ করে। একই সঙ্গে এডিবি দারিদ্র্য বিমোচনেও একটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করে।

এডিবির মূল্যায়ন অনুযায়ী ২১ জেলা পদ্মা সেতুর উপকারভোগী হবে। একই সঙ্গে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই সমুদ্রবন্দর মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রার সঙ্গে যোগাযোগও সহজ করবে। ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী একসময় শিল্প নগরী খুলনা এবং বরিশাল উত্তরের রাজশাহী ও রংপুরের চেয়েও পিছিয়ে ছিল। দক্ষিণের এই দুটি এলাকা এখনও পিছিয়ে আছে। জরিপ অনুযায়ী তখন দেশে ৭৮ লাখের মতো অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল। কিন্তু সাতটি বিভাগের মধ্যে তখন সবচেয়ে কম ছিল বরিশাল, খুলনা ও সিলেটে। তখন রংপুরে অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল ১০ লাখ। বরিশালে সেখানে ছিল মাত্র তিন লাখ। এর কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন। এখন সেই দুর্বলতা কেটে নতুন যুগে প্রবেশের অপেক্ষায় এই দুই বিভাগ। তবে এরইমধ্যে জাজিরা প্রান্তে, ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে জমির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর অর্থ পদ্মা সেতুকে ঘিরে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মেরুকরণ শুরু হয়ে গেছে।

এখানে একটি বিতর্ক উল্লেখ করা দরকার। পদ্মা সেতুতে ধার্য করা টোলকে প্রবৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকে। এ কথা ঠিক সময় বাঁচবে। কৃষিজাত পণ্য ফেরিঘাটে পচে যাওয়ার মতো কোনও ঘটনাও হয়তো ঘটবে না। কিন্তু যেই পরিমাণ টোল ধরা হয়েছে তা কৃষিপণ্যবাহী পরিবহনের জন্য কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা ভেবে দেখতে হবে। ধরুন একই কৃষিপণ্য যমুনার ওপার থেকে ঢাকায় পরিবহনে যে খরচ হবে সেই পণ্য বরিশাল থেকে ঢাকায় প্রবেশ করতে খরচ পড়বে বেশি। যেমন, বরিশাল থেকে একটি কৃষিপণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করতে টোল দিতে হবে কমপক্ষে তিনটি সেতুতে। এছাড়াও থাকবে এক্সপ্রেস ওয়ের টোল। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করতে হবে। কারণ, এই খাতের জনগোষ্ঠীর ওপর ভর করে মহামারিকালেও অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্বমন্দা যখন ধেয়ে আসছে তখন কৃষকদের সুবিধা দিতে না পারলে উন্নয়নের সুফল কী পাওয়া যাবে?

পৃথিবীর অনেক দেশ রয়েছে যেখানে কৃষিপণ্যবাহী যানবাহনে সেতু বা হাইওয়ে টোল নেওয়া হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর উদাহরণ যে নেই তা কিন্তু নয়। সেখানেও বহু সড়ক ও সেতুতে কৃষিপণ্যবাহী যানবাহনে টোল নেওয়া হয় না। দেশের কৃষকরা যদি টোল ফ্রি পরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারেন তবে কৃষি খাত আরও এগিয়ে যাবে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকন্যার এই চেষ্টা আরও বেগবান হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সবসময়ই কৃষকবান্ধব। তিনি সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলে হয়তো পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আনন্দের সঙ্গে একটি চাপাকান্না থেকেই যাবে কৃষকের।

লেখক: সাংবাদিক

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ড্রয়ে ক্লাব বিশ্বকাপ শুরু মেসির মায়ামির

নতুন কিছু প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে জমকালো উদ্বোধ...

ইডেন কলেজের পুকুরের পানিতে ডুবে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের পুকুরের পানিতে সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবে সানজিদা আক্ত...

বাংলাদেশ সিরিজের জন্য শ্রীলঙ্কার টেস্ট স্কোয়াড ঘোষণা

পূর্ণাঙ্গ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে শ্রীলঙ্কা সফরে গেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট...

ইরান ট্রাম্পকে হত্যা করতে চেয়েছিল, দাবি নেতানিয়াহুর

ইরানের শাসকগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাদের সবচেয়ে ব...

দেশ ছাড়ার ভাবনা গায়ক তাসরিফ খানের

জনপ্রিয় গায়ক, সমাজসেবক, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও কুঁড়েঘর ব্যান্ডের ভোকাল ত...

আজ সোমবার থেকে ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস

গত কয়েকদিন ধরে মৃদু তাপপ্রবাহের পর বৃষ্টিপাতের আভাস পাওয়া গেছে। দেশের বেশিরভা...

ঈদযাত্রা ‘স্বস্তিদায়ক’ না হওয়ায় ‘দুর্ঘটনা ও হতাহত বেড়েছে’: যাত্রী কল্যাণ সমিতি

উৎসব বা আনন্দ করতে গিয়ে অনেক সময় নিরানন্দে পরিণত সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। তাই যথা...

বাংলাদেশ সিরিজের জন্য শ্রীলঙ্কার টেস্ট স্কোয়াড ঘোষণা

পূর্ণাঙ্গ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে শ্রীলঙ্কা সফরে গেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট...

বাবাকে নিয়ে মন্দিরার পোস্ট

পবিত্র ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া ‘নীলচক্র’ ছবিতে অভিনয় করেছেন নবাগত...

ইডেন কলেজের পুকুরের পানিতে ডুবে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের পুকুরের পানিতে সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবে সানজিদা আক্ত...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা