আব্দুর রশিদ
সারাদেশ

আক্ষেপ নিয়েই একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব

আমিরুল হক, নীলফামারী : মন থেকে ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিলের বীভৎসতার দৃশ্য মুছতে পারেননি আব্দুর রশিদ। সেদিন তার চোখের সামনে পরিবারের ১০ জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর অনেকবার বিভীষিকাময় সেই দিনের স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি। কী লাভ হলো তাতে? এখনো শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি মিলল না। তাই এখন আর এসব কাউকে বলতে চান না আব্দুর রশিদ।

আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার সরকারের পদত্যাগ দাবি

আব্দুর রশিদ এখন বয়স ৬২ বছর। স্বাধীনতার সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার বাঁশবাড়ী মহল্লায় তাদের বসবাস। তার দাদা আব্দুল ওয়াদুদের একটি রুটি বিস্কুটের কারখানা ছিল। সেখানেই ১১ সদস্য পরিবার নিয়ে তাদের বসবাস। দাদা ছিলেন আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় দাদা নৌকা মার্কার প্রতীক লেবেল ছাপিয়ে ওই রুটি বিস্কুটের প্যাকেটে লাগিয়ে বিক্রি করতেন। সে সময় তিনি শহীদ ডা. জিকরুল হকের জন্য ভোট চাইতেন। এটাই ছিল তাদের পরিবারের বড় অপরাধ। এতেই ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর অবাঙালীরা।

শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) বাঁশবাড়ীর বাড়িতে গেলে ষাটোর্ধ্ব আব্দুর রশিদ প্রথমে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তার মনে একটা ক্ষোভ আছে। অনেক অনুরোধের পর তিনি কথা বলতে রাজি হন। সেইদিনকার বিভীসিকাময় ঘটনা বলতে গিয়ে বলেন, ৭১ এর ১৫ এপ্রিল দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বাইরে চৈত্র বৈশাখের তাপদাহ । সূর্য সবে হেলেছে একটু পশ্চিমের দিকে। অন্যান্য দিনের মত আমার বাবা মোহাম্মদ শহীদ ও বড় ভাই আবু সাকের গেছে বিমান বন্দরের কাজে। অসুস্থতার কারণে দাদা যেতে না পারায় বাসাতেই ছিলেন । দুপুরের খাবার সেরে দাদা চেয়ারে বসে পান খাচ্ছিলেন। আর আমি ছিলাম বারান্দায়। দাদী এবং মা পাশের ঘরে। ছোট ভাই ও বোনেরা বাইরে খেলছিল। ঠিক এ সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ইজাহার আহমেদ ও ওয়াহিদসহ অন্যরা দাদার ঘরে ঢোকে এবং দাদাকে দেখে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। দাদা কিছু বলার আগেই ওয়াহিদ তার পেটে ছুরি চালিয়ে দেয়। চিৎকার আহাজারি করতে থাকে দাদি। এ সময় দাদি রাজাকার ইজাহারের পা জড়িয়ে ধরে তার স্বামীকে বাঁচিয়ে তোলার আকুতি জানায়। কিন্ত নরঘাতক ইজাহার তার দাদির গালে থাপ্পর মারে। এতে দাদির নাকের ফুল ছিড়ে নাক দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ছোট ভাই বোনেরা ছুটে আসে। ভয়ে কোন কিছু বলার আগেই তাৎক্ষণিক তাদের চোখের সামনেই তারা দাদার লাশ মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়। সন্ধায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরে বাবা ও বড় ভাই। বাড়ির অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বাড়ির লোকজন। এসময় প্রতিবেশী এক অবাঙালী তাদের পরামর্শ দেয় আত্মগোপনের। আমার বড় ভাই ও বাবা পাশের বাসায় আত্মগোপনে যায়। দাদী, মা, ৪ বোন ভাইসহ আমি থেকে যাই বাড়িতে। হটাৎ আত্মচিৎকার শুনতে পেয়ে আমি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখি তার মায়ের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এমন নির্মম হত্যাকান্ড দেখে আমি মায়ের কাছে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্ত বাবা মুখ চেপে ধরেন আমার। ভাই রাশেদ ও বোন হাসিনাকেও উপর্যুপরি ছুড়িকাঘাতে হত্যা করে তার চোখের সামনে। দাদিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারার সময় বার বার বলতে থাকে, তুমহারা লাড়কা আউর পোতালোক কাহা ? (তোমার ছেলে ও নাতিরা কোথায়?) দাদি তখন নির্যাতনের যন্ত্রণা সইতে না পেরে ওদেরকে জানিয়ে দেয়, সাথে সাথে হায়নারা দাদির মাথায় বেয়নেট খুচিয়ে হত্যা করলো। এরপর ওরা আমার বাবা ও বড় ভাইকে ধরে নিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী দোহলা এলাকায়। সেখানে তারা বড় ভাইকে পৌরসভার গভীর সেফটিক ট্যাংকীর ভেতর জীবন্ত ফেলে দেয়। আমি ও বাবা সেখান থেকে কোন রকমে পলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। তখন ওরা বাবাকে লক্ষ্য করে বল্লম ছুড়ে মারলে পায়ে লেগে যায়। তখন তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এরপর তারা একটি হাত কেটে নেয়, এরপর চিৎকরে শুইয়ে জবাই করে। পরে তারা হাত পা ধরে অনেক লাশের মাঝে ফেলে দেয়।

তবে এসব লাশ কাদের ছিল রশিদ বলতে পারেনি। সেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসে নিজ বাড়িতে। কিন্ত সেখানে আরও পৈশাচিক দৃশ্য দেখতে হয় রশিদকে। তিন নরপশু তখন রশিদের বেঁচে থাকা একমাত্র বড় বোন নুর জাহানকে নিয়ে পৈশাচিকতায় মেতেছে । সে ছিল নববিবাহিতা। বিয়ে হয়েছিল খুলনায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বাড়ি এসেছিল। পরে আর স্বামীর বাড়ি যাওয়া হয়নি। বড় বোনের উপর আদিম অত্যাচারের দৃশ্য ছিল ভিন্ন, নির্যাতনের পর তার দুটি স্তন কেটে নিয়ে হত্যা করে নর পিচাশেরা। রশিদ তার বোনের ইশারায় পালিয়ে গিয়ে একটি টয়লেটে লুকিয়ে থাকে। ততক্ষনে নিশ্চিত রশিদ সব শেষ হয়ে গেছে তার।

আরও পড়ুন: রূপপুর প্রকল্পে বিদেশি নাগরিকের মৃত্যু

রশিদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তখনও ছিল না। বিধিবাম, লুকিয়ে থাকা অবস্থায় সেখানে আসে পাকিস্তানের দোসর ভাসানি নামের অবাঙালী তরুন। ভাসানি রশিদকে জিজ্ঞেস করে তুম কুছ খ্যায়া হ্যায় ? (তুমি কিছু খেয়েছো) পরে সে তার লুকিয়ে থাকার বিষয়টি জানায় মনির খাঁনকে। মিনিট কয়েক পরেই হাতে রক্ত মাখা একটি ছোড়া নিয়ে মনির আসে রশিদের সামনে সেখান থেকে ধরে টেনে হিছরে নিয়ে যায়। পথেরমধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চেয়ারে বসে থাকা তৌহিদ নামের এক ব্যক্তি মনিরকে জিজ্ঞেস করে “তুম উসকো কাহা লেজাহারা? (তুমি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো) মনির জানায় , খাতাম কারনেকেলিয়ে ( হত্যা করতে) জবাবে তৌহিদ নরঘাতক মনিরকে বলে “তুমলোক আদমি হ্যায়না জানোয়ার ? (তোমরা মানুষ না জানোয়ার) ওর পরিবারের সবাইকে শেষ করার পর একটা বাঁচ্চাকে ছাড়তে পার না?। সবশেষে সবাইকে হারিয়ে সে প্রতিবেশী এক অবাঙালী পরিবারে যুদ্ধ চলাকালীন ৯মাস পালিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্য এক বাঙালী পরিবারে চলে যান রশিদ।

আব্দুর রশিদ বলেন, নিজের চোখের সামনে একে একে সবাইকে হারিয়ে শুধু আমি বেঁচে যাই। কিন্তু কোনো স্বীকৃতি মিলল না। হয়ত এই আক্ষেপ নিয়েই আমিও একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব।

সাননিউজ/এমআরএস

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ভোলায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত 

ভোলা প্রতিনিধি: তীব্র তাপদাহ থেকে...

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীর গণসংযোগ

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ

সান নিউজ ডেস্ক: আজ বিশ্ব ম্যালেরি...

টঙ্গীবাড়ি ভাতিজারা পিটিয়ে মারলো চাচাকে

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

গরমে ত্বক ব্রণমুক্ত রাখতে যা খাবেন

লাইফস্টাইল ডেস্ক: গরমকাল এলেই ব্র...

মাকে গলা কেটে হত্যা করল ছেলে

জেলা প্রতিনিধি: বিয়ে না দেওয়ায় চা...

পঞ্চগড়ে দুই শিশুর মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ে চাওয়াই নদীতে গোসল করতে নেমে আলমি আক্...

চারতলা থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু

খায়রুল খন্দকার টাঙ্গাইল : টাঙ্গাই...

শনিবার ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না 

নিজস্ব প্রতিবেদক: পাইপলাইনের কাজে...

ভারতীয় ৩ কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্র স...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা