নাগা সাধু
ফিচার

নাগা সাধুরা মোহমুক্ত, থাকেন নগ্ন

আহমেদ রাজু : নাগা সাধুরা লোভ, কাম, ক্রোধ ও মোহ থেকে মুক্ত। তাই তারা নগ্ন থাকেন। পৃথিবীর কোনো মায়া তাদের স্পর্শ করে না। তাদের উদ্দেশ্য সারাক্ষণ সত্যের সন্ধান। নাগারা শরীরে ভষ্ম মাখেন। তেল ও সাবান মাখা নিষিদ্ধ। তাদের কোনো যৌনবাসনা নেই। বিশেষ প্রক্রিয়ায় নষ্ট করে দেয়া হয় তাদের যৌনাঙ্গ। আট বছর বয়স থেকে শুরু হয় নাগা সাধু হওয়ার প্রশিক্ষণ। একজন নাগা সাধু হতে প্রশিক্ষণের শুরু থেকে সময় লাগে বিশ বছর।

প্রতিবছর কুম্ভেমেলায় আসে লাখ লাখ নাগা সাধু। অনেকের বিশ্বাস—তাঁরা থাকেন হিমালয়ের গহীনে। কুম্ভে দর্শন দেন। কিন্তু এই ধারণার বাস্তব ভিত্তি নেই। পুণ্য স্নানের জন্য নাগা সন্ন্যাসীরা আসেন গঙ্গাসাগর

নাগা সাধু সহজে কেউ হতে পারে না। কারণ, নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার প্রক্রিয়া খুব কঠিন। খুব গোপনীয়। সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য বেশ কিছু কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ১২ বছর পর্যন্ত চলে কঠোর প্রশিক্ষণ। এই সময় নিজেদের খাদ্য নিজেই তৈরি করতে হয়। করতে হয় গুরুর সেবা।

প্রশিক্ষণ চলাকালীন কোনো ভুল হলে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। একজন মানুষের নাগা সন্ন্যাসী হতে ২০ বছর সময় লাগে। আট বছর বয়স হলে প্রতিষ্ঠানের মহাত্মারা নাগা সাধু হতে ইচ্ছুক শিশুদের কাছে লাখ লাখ টাকার দায়িত্ব দিয়ে পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষায় পাশ করলে ওইসব শিশুদের একটা ছোট্ট মন্ত্র দেওয়া হয়।

এরপর ১২ বছর বয়সে তার আসল প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বাল নাগাদের প্রশিক্ষণ অনেকটা সেনা বাহিনীর জওয়ানদের মতো। যে কোনও পরিস্থিতিতে তাদের থাকতে হবে অটল। প্রয়োজনে মাতৃভূমি এবং সমাজের জন্য অস্ত্র ধারণ করতে হবে। নাগা সন্ন্যাসীরা মনে করেন সন্ন্যাসীদের নিজের কোনো সংসার থাকে না। তাই তারা নিঃস্বার্থভাবে মাতৃভূমি ও সমাজের সেবা করতে পারেন।

কিন্তু সব সন্ন্যাসীরা নাগা নয়। এদের তিনটি ভাগ আছে—নাগা, তান্তোরা ও নির্বাণ। বাল নাগা সাধু এই তিন শ্রেণির যে কোনও একটির দীক্ষা নিতে পারে। এ এমন এক আধ্যাত্মিক জগৎ যার ধারে কাছে সাধারণ মানুষ পৌঁছতে পারে না।

চারটি কুম্ভের পর ব্রম্ভচারি বালকদের নাগা সন্ন্যাসের দীক্ষা দেওয়া হয়। তারপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাদের যৌনাঙ্গ নষ্ট করে দেওয়া হয়। তারা সারাজীবন গায়ে তেল ও সাবান লাগাতে পারেন না। সারা শরীরে তারা ভস্ম মেখে রাখে। যে সব খাদ্য শরীরে উত্তেজনা তৈরি করে, সেই সব খাদ্য থেকে এদের দূরে থাকতে হয়। ব্রহ্মমুহুর্তে তাদের মন্ত্রদান করা হয়। এই মন্ত্র এক সাধনা।

সন্ন্যাসীরা যে ভষ্ম শরীরে মেখে রাখে, তা তাদের বিষাক্ত সাপ ও মশা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু এই ছাইয়ের মধ্যে গোবর, বেলপাতা ও কলাসহ আরও অনেক কিছু মেশানো থাকে। এর মধ্যে কাচা দুধ মিশিয়ে এক মিশ্রণ তৈরি করে তারা শরীরে মাখে। এরা ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠেন। তারপর হবন, ধ্যান, বজ্রোলি, প্রাণায়ম, কপাল ক্রিয়া ও নৌলি ক্রিয়া করেন।

নাগা সাধু দিগম্বর অখিলেশপুরী বলেন, আমাদের লিঙ্গ অকেজো করে দেওয়া হয়। আমাদের কোনও কামনা-বাসনা থাকে না। যারা যৌন কামনার প্রবল বেগকে সামলে নিতে পারে, তারাই নাগা। কাম, ক্রোধ ও লোভ থেকে সেই সিদ্ধি লাভ করে যে যৌন বাসনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়। নাগা অর্থ যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃত সত্য সন্ধান করে। নাগারা সাংসারিক জীবন থেকে দূরে থাকেন। তাদেরকে বলা হয় ত্যাগের প্রতীক।

কিছু সৈন্যাসী সারাবছর গেরুয়া পরে থাকেন। গ্রামের মন্দিরে, বটগাছের নীচে যে সব সাধু স্বাভাবিক ভাবে সারা বছর থাকেন, তারা নাগা নন। শাহী স্নানের সময়েই কেবল নাগাদের দেখা মেলে। নাগা সাধুরা কখনো কাপড় পড়েন না। সবসময় তারা নগ্ন থাকেন। নগ্ন থাকার কারণ হলো পৃথিবীর সবরকমের লোভ, লালসা ও মোহ থেকে তারা মুক্ত।

কুম্ভমেলা শুধু স্নান নয়, সাধুদের উৎসব। প্রতি চার বছর অন্তর কুম্ভ আখড়ার পদাধিকারীদের নির্বাচন হয়। কে হবেন শ্রীমোহান্ত বা প্রধান, কে হবেন আখড়ার ট্রেজারার বা ‘কারোবারি’ সবেরই নির্বাচন এই কুম্ভে। মোহান্ত, কারোবারি ছাড়াও নির্বাচিত হন ‘কোতোয়াল’ ও ‘পুজারি’।

পুজারির কাজ পুজো করা। কোতোয়াল আখড়ায় শান্তিরক্ষা করেন, সাধুদের বিবাদ-বিসংবাদ মেটান। আমাদের, সাধারণ মানুষের মতোই সামাজিক ব্যবস্থাপনা। আখড়ার প্রধান সন্ন্যাসীরা মনে মনে বিমুক্ত হলেও নাগাবেশ ধারণ করে থাকেন না।

নাগা সন্ন্যাসীদের এক-একটি আখড়ায় এক-এক জন ইষ্টদেবতা। নিরঞ্জনী আখড়ার ইষ্টদেব হলেন কার্তিকেয়। বাঙালির শৌখিন, ফ্যাশনদুরস্ত কার্তিক ঠাকুর নন, দেব সেনাপতি কার্তিকেয়। জুনা আখড়ার ইষ্টদেব মহাযোগী দত্তাত্রেয়। ইনি রুদ্রের আর এক রূপ। আনন্দ আখড়ার ইষ্টদেব সূর্য, অটল আখড়ার গণপতি।

আখড়াগুলির সম্পত্তি প্রচুর। বারাণসীতে জুনা আখড়ার আলাদা মঠ ও ঘাট, প্রয়াগে রয়েছে নিরঞ্জনী আখড়ার সদর দফতর। বড় বড় সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা আলাদা আশ্রমে থাকেন, কিন্তু শাহি স্নানে সকলেই থাকবেন নিজস্ব আখড়ার সঙ্গে।

যেমন, পাইলটবাবা। একদা পাইলট ছিলেন, এখন ডাকসাইটে সাধু। অজস্র দেশি, বিদেশি ভক্তমণ্ডলী। কিন্তু তিনি সবসময় শাহি স্নানে থাকবেন জুনা আখড়ার সঙ্গে। সেখানকারই সদস্য তিনি। শ্রীঅমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের মোহান্ত দীপেন্দ্র গিরি আবার নিরঞ্জনী আখড়ার। বাঙালি কনখলে আনন্দময়ী মা’র আশ্রম চেনে। সন্ন্যাস-কুলুজিতে তিনি মহানির্বাণী আখড়ার মহামণ্ডলেশ্বর ছিলেন।

ঐতিহাসিকদের মতে—মুঘল আমলের শেষ দিক থেকে এই আখড়াগুলির অবস্থা ছিলো রমরমা। এঁদের গজির মোহান্তদের ভূসম্পত্তি ছিলো। উপরন্তু টাকা ধার দিতেন। রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধে ভাড়াটে সৈন্য হিসাবেও সার্ভিস দিতেন।

নিরঞ্জনী আখড়া যেমন বলে, তাদের প্রতিষ্ঠা ৯০৪ খ্রিস্টাব্দে। অগ্নি আখড়া বলে, ৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাদের শুরু। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার এই দুই মতের কোনওটাই স্বীকার করেননি। তাঁর মতে, নিরঞ্জনী আখড়ার শুরু ১৯০৪ সালে। অগ্নি আখড়া ৪৫৭ নয়, ১৪৫৭ সালে আরম্ভ। নাগা সন্ন্যাসীরা মানুন বা না-মানুন, আধুনিক ইতিহাস কিন্তু যদুনাথের সমর্থনেই।

সান নিউজ/এসএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

আজ বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ...

খাগড়াছড়িতে গৃহকর্মীকে জিম্মির অভিযোগ 

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিঃ

কাতারের সঙ্গে ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই 

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ও কাতা...

আড়িয়ল ইউপিতে উপ-নির্বাচন

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

কার্বণ মিল ও সীসা কারখানা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী প্রতিনিধি:

কক্সবাজারে দুই জেলের লাশ উদ্ধার 

জেলা প্রতিনিধি: কক্সবাজার জেলার চ...

আড়িয়ল ইউপিতে উপ-নির্বাচন

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

খাগড়াছড়িতে গৃহকর্মীকে জিম্মির অভিযোগ 

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিঃ

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা