ঘুর্নিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের একটি স্থান -ফাইল ছবি
পরিবেশ

দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণের এখনি সময়

মু. সায়েম আহমাদ

পৃথিবীর সৃষ্টি বৈচিত্র্যময়। আর সেই পৃথিবীর সৃষ্টির পাশাপাশি প্রলয়ও সম্মিলিতভাবে বিরাজমান। পৃথিবীর উপর সময়ে অসময়ে নানা বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। আর সেই বিপর্যয় প্রাকৃতিক হোক কিংবা মনুষ্য সৃষ্টি হোক। উভয় ধরনের হতে পারে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন: বর্তমানে পুরো বিশ্বজুড়েই করোনাভাইরাস নামক রাজত্ব করে চলছে।

শুধু যে করোনাভাইরাস পৃথিবীকে অচল করে দিয়েছে তা কিন্তু নয়। বরং পৃথিবীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে বিভিন্ন ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ও সুপরিচিত। সেই হিসেবে যদি বলি তাহলে, সিডর, সুনামি ও ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, আম্ফান বেশ পরিচিত।

পাশাপাশি আমাদের দেশের বন্যা ও খরার পরিস্থিতিও খুবই ভয়াবহ। গেল বছর ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডবে আমাদের দেশে ক্ষত বিক্ষত করেছে। যার ঘাঁ এখনো শুকায়নি। সেই আম্ফানের বর্ষপূর্তি হতে না হতেই করোনাভাইরাস এর রাজত্বের মধ্য দিয়ে পূর্ব বঙ্গোপসাগরে তৈরি হতে চলা আরো একটি ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় "ইয়াস"।

দ্য ফ্রী প্রেস জার্নাল এর মতে, "ইয়াস" নামটি ওমানের দেওয়া এবং শব্দটির উৎপত্তি পার্সি ভাষা থেকে। ইংরেজিতে "জেসমিন" বলা হয় আর পার্সি ভাষায় "YASS" এর উচ্চারণে "ইয়াস" বলে। ভয়ানক এই ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর। ধারণা করা যায় ঘূর্ণিঝড়টি চলমান এই সপ্তাহের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্থল ভাগের প্রবেশ করতে পারে। শুরুর দিকে লঘুচাপ থেকে নিম্নচাপের সম্ভাবনা থাকলেও পরবর্তীতে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়ে আঘাত হানার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আর এই ভয়ানক থাবা মোকাবেলা করতে আমরা কতটুকু পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছি সেটি প্রশ্ন। কেননা গেল বছর ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডবে আমাদের দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই হিসেবে বলতে গেলে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে যখন আঘাত হেনেছিল তখন দেশের দুই কোটি ২০ লাখেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যা দেশের মোট গ্রাহকের প্রায় ৬০ শতাংশ।

শুধু যে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে তা কিন্তু নয় বরং দেশে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কৃষক সমাজের হাজার হাজার বিঘায় গড়ে উঠা মৎস্য খামার ও ফসলি জমির ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে সঠিক চিকিৎসা থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছিল। আর এসব ক্ষয়ক্ষতির হিসেব যদি টাকার অঙ্কে বলা হয় তাহলে প্রায় ১১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডবে ২৬ জন মানুষের প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের দেশে শুধু যে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এমন কিন্তু নয়। বরং এদেশে পূর্ববর্তী বা অতীতেও আম্ফান এর চেয়ে আরো বেশি ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। যার ফলশ্রুতিতে এদেশে ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০০৭ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে সিডর ও আইলাতে যথাক্রমে ১০ হাজার ও ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়াও লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরে ঝড়ের প্রভাবে প্রায় ৯৬৮,০০০ ঘরবাড়ী ধ্বংস এবং ২১০,০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এ ঝড়ে প্রায় ২৪২,০০০ গৃহপালিত পশু এবং হাঁসমুরগী মারা গেছে। বাংলাদেশের প্রায় ৬০০,০০০ টন ধান নষ্ট হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে।

বিপুল সংখ্যক প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে। টাকার অঙ্কে যদি এই দুটি সাইক্লোন এর ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করি তাহলে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ও ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২০০ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ২০০-এর বেশি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এমন ঘূর্ণিঝড় ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সারাদেশে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

তাই আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য যথাযথ পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হবে। আর সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও যশসহ সব ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবেলা করার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করার সময় এখনি। আমাদের দেশে উপকূলীয় অঞ্চল গুলোতে বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারণ উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন হতে হয়।

এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ের আর একটি মারাত্মক দিক হলো জলোচ্ছ্বাস। তাই উঁচু করে মজবুত আশ্রয়স্থল তৈরি করতে হবে। এসব অঞ্চল মানুষগুলোকে সচেতন থাকার জন্য পূর্ব বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। আশ্রয়স্থল এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রয়োজনে আশ্রয়স্থল হিসেবে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার স্থাপনাগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। আশ্রয় কেন্দ্রে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে তরুণীদের।

কারণ নারীরা এসব জায়গায় হেনস্তার শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য নারীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। মানুষ আশ্রয়স্থলে অবস্থান করলেও তাদেরকে যথাযথ খাদ্য সামগ্রী প্রদান করা হয় না। সেজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুদ করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বিশুদ্ধকরণ টেবলেট ও ওয়াটার ট্যাংকের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ দুর্যোগের সময় সবাই সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করে উঠে। এক্ষেত্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

এছাড়াও গবাদি পশু (গরু, মহিষ, ছাগল) কোথায় থাকবে তা আগে থেকে পরিকল্পনা করতে হবে। কারণ তাদেরও জীবন রক্ষা করতে হবে। এ সময় আরো একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেটি হচ্ছে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগের উৎপত্তি ঘটে।

আর সেজন্যই সঠিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলা করতে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে এবং সেই সাথে জনবলদের সব ধরনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। যেসব জায়গায় বেড়িবাঁধ রয়েছে সেগুলো টেকসই ভাবে নির্মাণ করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, বিধ্বংসী সিডর, সুনামি, মহাসেন, বুলবুল ও আম্ফানের তান্ডবে আমাদের সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়। মানুষ তার সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে প্রয়োগ করেও প্রকৃতির এই রোষানল থেকে রক্ষা পেতে পারেনা।

তাই আজ মানব জীবনের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত পরিবেশ রক্ষা এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ। আর এই ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়গুলো দেখিয়ে দিয়ে গেল যে বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূল ত্রুটিগুলি ঠিক কোন জায়গায়। তাই একদিকে যেমন আমাদের প্রকৃতিকে সংরক্ষণের কাজে অবতীর্ণ হতে হবে। অন্যদিকে বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রশাসনিক ব্যবস্থার ত্রুটি গুলি নির্মূল করার দিকেও নজর দিতে হবে।

লেখক: মু. সায়েম আহমাদ (শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ)

সান নিউজ/এমএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উত্তরায় প্রাইভেটকারে অপহরণ; ভিডিও ভাইরালের পর গ্রেপ্তার ২

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনায় অপহরণে ব্যবহৃত একটি প্রাইভে...

আমাকে চেয়েছিলো যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী বানাতে: ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত সরকারের সময় তিনবার...

ভালুকায় সৌন্দর্য বাড়াতে ইউএনও’র ‘নিজ খরচে’ সবুজ বিপ্লব

ভালুকা উপজেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও নগর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নি...

কালীগঞ্জে ফিল্মিস্টাইলে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জে...

সড়কহীন ৩৪ কোটি টাকার সেতু

সেতু আছে কিন্তু সংযোগ সড়ক করা হয়নি এমন সেতু ফেনীতে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা