বিভুরঞ্জন সরকার- সাংবাদিক
মতামত

কবে আমরা সতর্ক হবো?

বিভুরঞ্জন সরকার

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এখন কেবল পোড়া লাশের দুর্গন্ধ। এই নদীতেই দাউ দাউ আগুনে পুড়েছে বরগুনাগামী লঞ্চ এমভি অভিযান-১০। আগুন লাগার পর দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে লঞ্চটি যখন এই ঘাট থেকে সেই ঘাটে ভিড়তে চেয়েছে, তখন কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন আর কেউ কেউ ফেলে আসা সন্তান বা প্রিয়জনকে খুঁজতে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন। কী মর্মান্তিক আর দুঃখজনক দৃশ্য, ভাবা যায়! অবস্থা এমন ছিল যে যাত্রীদের আর্তচিৎকারে আশপাশের গ্রামের মানুষের ঘুম ভেঙে গেলে তারা ট্রলার নিয়ে এসেও অনেককে রক্ষা করতে পারেনি। চোখের সামনেই অনেকেই পানিতে ভেসে গেছে।

বরগুনার আকাশে-বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে স্বজন হারানোদের করুণ আহাজারি। এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন ঘুরেফিরে মাথায় আসছে–ভাগ্য খারাপ হলে হয়তো ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো কিংবা অগ্নিদগ্ধদের তালিকায় আমি এবং আমার মা-ও থাকতে পারতাম। ওই দিন আমাদের এই লঞ্চে যাত্রী হওয়ার কথা ছিল। প্রাথমিকভাবে একটি কেবিনও রাখা হয়। কিন্তু নিকটাত্মীয়দের পীড়াপীড়িতে শেষ মুহূর্তে কেবিনটি বাতিল করি। ফলে দুর্ঘটনাকবলিতদের তালিকায় আমাদের নাম না উঠলেও শুক্রবার ঘুম থেকে উঠে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর শুনে দিনটাই আমার বিষণ্ণতায় কেটেছে। আরেকটি ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়মিত ব্যাপার হলেও এ রকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কিন্তু নজিরবিহীনই বলা চলে।

অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো কিংবা অগ্নিদগ্ধদের তালিকায় আমি এবং আমার মা-ও থাকতে পারতাম। ওই দিন আমাদের এই লঞ্চে যাত্রী হওয়ার কথা ছিল। প্রাথমিকভাবে একটি কেবিনও রাখা হয়। কিন্তু নিকটাত্মীয়দের পীড়াপীড়িতে শেষ মুহূর্তে কেবিনটি বাতিল করি। ফলে দুর্ঘটনাকবলিতদের তালিকায় আমাদের নাম না উঠলেও শুক্রবার ঘুম থেকে উঠে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর শুনে দিনটাই আমার বিষণ্ণতায় কেটেছে।

বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার পেছনে অসংখ্য কারণ থাকে– যেমন বৈরী আবহাওয়া, নির্মাণত্রুটি কিংবা ইকুইপমেন্ট ফেইলিউর। তবে প্রাথমিকভাবে যা ধারণা করা গেছে তাতে অভিযান-১০ লঞ্চের ক্ষেত্রে এর কোনোটিই ঘটেনি। লঞ্চের কেবিন বয়ের জবানবন্দির ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ইঞ্জিনরুমের পাশে খাবারের হোটেলের জন্য ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে এটাই মূল কারণ কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আরেকটি ব্যাপারও সামনে এসেছে। সম্প্রতি লঞ্চটিতে সমুদ্রগামী জাহাজের দুটি রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল। যে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহারের অনুমতি নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, যাত্রার আগে খালি অবস্থায় ট্রায়ালের কথা থাকলেও সেটা দেওয়া হয়েছে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে পুরো গতিতে ইঞ্জিন দুটো একসঙ্গে চালিয়ে। আর এতেও ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তদুপরি আগুন লাগার পর ইঞ্জিনরুমে মজুত থাকা কেরোসিন, দাহ্যপদার্থ লুব্রিকেট ও হাইড্রোলিক অয়েলের কারণে দ্রুত তা পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। কারণ, দাহ্যপদার্থ লঞ্চের ইঞ্জিনরুমে মজুত থাকলে যেমন নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখতে হয়, ওই লঞ্চে তা ছিল না। তদন্ত প্রতিবেদনে এসব প্রসঙ্গ উঠে আসুক বা অন্য কিছুই থাকুক না কেন, একটি প্রশ্ন কিন্তু ইতিমধ্যেই উঠেছে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই যদি এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে, তাহলে সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়?

অন্যদিকে, এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌযানে যেসব অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকে, সেগুলোর প্রায় সবই মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা অকার্যকর। লঞ্চ প্রথমবার নদীতে ভাসানোর সময় যেসব যন্ত্র সেট করা হয়, তারপর সেগুলোর কী অবস্থা, সচল আছে কি না, তা আর কখনো চেক করা হয় না। নির্বাপণযন্ত্র ছাড়াও আরেকটি কথা হলো, যারা আগুন নেভাবেন কিংবা ইন্সট্রুমেন্টগুলো ব্যবহার করবেন, তাঁদেরও তো সেগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণ লাগবে। এগুলোও আমাদের এখানে কখনোই করা হয় না। প্রশিক্ষণ কেবল লঞ্চচালক বা কর্মচারীদের নয়, প্রশিক্ষণ তো যাত্রীদেরও দরকার।

লঞ্চে থাকা টেলিভিশনে ভিডিওর মাধ্যমে যাত্রা শুরুর আগে নিরাপত্তার বিষয়টি তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। অথচ এসব কিছুই আমাদের এখানে কখনোই করা হয় না। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রতিটি লঞ্চেই ইঞ্জিনরুমের পাশে ক্যানটিনের অবস্থান। ক্যানটিনের অবস্থান কি ওখানেই থাকা উচিত, নাকি ওপরের কোনো একটা জায়গায় হলে সেটি বেশি নিরাপদ, সেটি নিয়েও ভাবার সময় এসেছে।

তবে দায় শুধু লঞ্চমালিক কিংবা কর্মচারীদের ওপরে চাপালেই হবে না, দায় আছে সরকারেরও। দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলোয় মূলত ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে শনিবার প্রচুর ভিড় থাকে। কারণ শুক্র-শনিবার অফিস বন্ধ থাকায় বৃহস্পতিবার অনেকেই গ্রামে যান। আবার রোববার অফিস খোলা থাকায় শনিবার সবারই ফেরার তাড়া থাকে। আর এই সুযোগে প্রতিটি লঞ্চ ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে যাত্রা করে।

অভিযান-১০ লঞ্চটিও এমনটি করেছিল। এ কারণে বেশির ভাগ যাত্রীই লাইফ জ্যাকেট পায়নি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। যদি আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হতো, জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকত, তাহলে যাত্রীরা সেগুলো ব্যবহার করে জীবন বাঁচাতে পারত। আবার এমন অভিযোগও এসেছে যে আগুন লাগার পরও কেবিনের যাত্রীদের অনেককে বের হতে দেওয়া হয়নি। ফলে পুড়তে পুড়তে তারা এতটাই পুড়েছে যে এক ভিডিওচিত্রে দেখা গেল, স্রেফ কয়লার স্তূপ ব্যাগের ভেতরে ঢোকাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলরত অনেক লঞ্চেরই ফিটনেস নেই। দু-একটি বাদে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চগুলোর অবস্থা তো যাচ্ছেতাই। ফলে বরগুনার অনেকেই নদীপথে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে তারপর সড়কপথে বরগুনা আসেন। তা ছাড়া অন্যান্য নৌরুটের তুলনায় এখানে ভাড়াও বেশি।

এগুলো দেখার যেন কেউ নেই! এই লঞ্চগুলোর ভেতরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অনেক কিছুই যেমন নেই, তেমনি অব্যবস্থাপনাও চরমে। তারপরও দেখা যাবে এ লাইনে চলাচলরত সব লঞ্চেরই ফিটনেস সনদ রয়েছে! অথচ এ ধরনের ফিটনেসের কোনো মূল্য নেই। এসব তদারকির জন্য রয়েছে নৌপরিদর্শক। এ ছাড়া প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের এগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করার কথা। যদি তাঁরা নিয়মিত এগুলোর দেখভাল করতেন, তাহলে অনেক দুর্ঘটনাই হয়তো এড়ানো সম্ভব হতো। বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর কিছুদিন তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, তারপর আর খবর থাকে না।

বাংলাদেশে প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনেই রয়েছে মূলত অসতর্কতা কিংবা দায়িত্বে অবহেলা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কত দিন? অভিযান-১০ লঞ্চটিতে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল তা কোনোভাবেই সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা অব্যবস্থাপনার এক চেইন অব ইভেন্ট। নৌপথকে নিরাপদ করতে অচিরেই এগুলোর সুরাহা করতে হবে। এ জন্য প্রচলিত আইনকে যুগোপযোগী করার সময় এসেছে। কারণ, প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু এ কারণেও ঘটছে যে, এসব দুর্ঘটনায় কারও তেমন কোনো শাস্তি হয় না৷

১৯৭৬ সালের একটি সরকারি অধ্যাদেশকে পাঁচ দফায় সংশোধন করার পরেও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে পাঁচ বছরের জেল আর মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা! তাই এই অব্যবস্থাপনাজনিত লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হলে প্রথমেই কঠোর শাস্তির বিধান করা করতে হবে৷ পাশাপাশি এই পুরো খাতটির ওপর কড়া নজরদারি বজায় রাখতে হবে৷ অন্যথায় এ রকম অব্যবস্থাপনাজনিত ঘটনা ভবিষ্যতে যেমন আরও ঘটবে, তেমনি জীবন যেতে থাকবে নিরীহ মানুষের।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক- সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

সান নিউজ/এফএইচপি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

হাইকোর্টের আদেশে সংক্ষুব্ধ শিক্ষামন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক: চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমি...

হরিপুরে হিট স্ট্রোকে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি: ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপ...

রাফাহতে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১৩

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের রাফাহতে ইসরায়ে...

এবার লাক্সের অ্যাম্বাসেডর হচ্ছেন সুহানা 

বিনোদন ডেস্ক: বলিউড বাদশা শাহরুখ খান ও গৌরি খান দম্পতির কন্য...

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ সোমবার (২৯ এপ্রিল) বেশ কি...

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় নিহত ৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় ৪ জন নিহত হয়ে...

কক্সবাজারে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার

জেলা প্রতিনিধি: কক্সবাজারের চকরিয়...

মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২০ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভি...

পেরুতে বাস খাদে পড়ে নিহত ২৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘ...

আজ ২৭ জেলায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: তীব্র তাপপ্রবাহ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা