জামালপুর প্রতিনিধি: স্বপ্ন ছিল অনিয়ম ও অন্যায়ের বেড়াজালে আবদ্ধ বাংলাদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত। তারপর তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়েই মরতে চেয়েছিলেন তিনি। অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই জামালপুরে বেঁচে থাকা সর্বশেষ ভাষাসৈনিক কয়েস উদ্দিন সরকার মারা গেলেন। সবার কাছে যিনি ছিলেন 'কায়েস ভাই' নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন: চলে গেলেন ভাষাসৈনিক ‘কয়েস ভাই’
শুক্রবার (২৫ আগস্ট) রাত ১১টার দিকে জামালপুর শহরের গেইটপাড় এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করা জীর্ণ ঘরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল একশোর বেশি।
জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. ইমরান আহমেদ তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, শনিবার সকাল ১০টায় কয়েস উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি বেলটিয়ায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাঁর মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেলা ১১টায় জামালপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়।
আরও পড়ুন: ঢাকা দক্ষিণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছি
মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম জানান, অকুতোভয় এই বীরের শেষ ইচ্ছা ছিল, মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য তাঁর মরদেহ দান করা। এজন্য সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাঁর মরদেহ জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেয়া হবে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন। অভাব-অনটনে জীবনযাপন করলেও নিজের নীতি-আদর্শ থেকে কখনও সরে আসেননি। দীর্ঘদিন অসুস্থ অবস্থায় থাকলেও গ্রহণ করেননি কোনো সরকারি সুযোগসুবিধা।
বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিত্তবান বা প্রতিষ্ঠান তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে চাইলেও ফিরিয়ে দিয়েছেন বিনয়ের সঙ্গে। বসবাস করেছেন জামালপুর শহরের গেইটপাড় এলাকার একটা জীর্ণ ঘরে।
আরও পড়ুন: আজও ভারি বৃষ্টির আভাস
কয়েস উদ্দিন সরকার শোষণ-বঞ্চনা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বহু গান রচনা করে গেছেন। নিজেই তাতে সুরারোপ করে গেয়ে বেড়াতেন। শহরের যেখানেই প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সভা চলুক না কেন, তিনি থাকতেন প্রথম কাতারে। গানের আবদার করলে মঞ্চে গান গেয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতেন।
তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী চেতনায় বিশ্বাসী। করেছেন ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন। শৈশবেই বাবাকে হারান, তাই খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি সাংসারিক অভাব-অনটনের কারণে।
১৯৫২ সালে জিন্নাহ যখন ঢাকার কার্জন হলে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা দেন, তখনই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। কয়েস উদ্দিন সরকার যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাসংগ্রামী হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি। আইয়ুববিরোধী গান রচনা করার জন্য আইয়ুব খানের মার্শাল লয়ের সময় এক বছর জেল খাটেন কয়েস উদ্দিন।
আরও পড়ুন: আগামীকাল দেশে আসছেন প্রধানমন্ত্রী
তিনি যাদের নেতৃত্বে জামালপুরে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন তারা হলেন তৈয়ব আলী, তাছির মোক্তার, মোয়াজ্জেম উকিল, হায়দর আলী মল্লিক, নাসির সরকার প্রমুখ। তিনিই ছিলেন জামালপুরে বেঁচে থাকা সর্বশেষ ভাষাসৈনিক। কয়েস উদ্দিন সরকারের মৃত্যুতে জামালপুরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গভীর শোক নেমে এসেছে।
কবি ও প্রাবন্ধিক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর বলেন, মৃত্যুর পূর্বে ভাষাসৈনিক কয়েস উদ্দিন সরকার দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। আমরা তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারিনি, এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। এখন অন্তত তাঁর অবদান ও গৌরবোজ্জ্বল পরিচয়কে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
এজন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভাষাসৈনিক কয়েস উদ্দিন গবেষণাগার বা জাদুঘর প্রতিষ্ঠাসহ জামালপুর অঞ্চলের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস সংরক্ষণ জরুরি বলেও তিনি মনে করেন।
আরও পড়ুন: দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে
জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. ইমরান আহমেদ মুঠোফোনে বলেন, আজ সকাল দশটায় পুষ্পস্তবক অর্পনের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। আমরা তার চাওয়াকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা জানাই।
এ বিষয়ে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি বাংলাদেশ একদিন সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
সান নিউজ/এইচএন