ভয়ংকরভাবে ফিরছে ডেঙ্গু ও করোনা। এক দিনে সর্বোচ্চ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু ও করোনা ভাইরাস উভয়ের আচরণ পরিবর্তন হয়ে এবার ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। আগে ডেঙ্গু জ্বর হলে প্রচণ্ড জ্বর, গিরায় গিরায় ব্যথা, কাশি ও গলা ব্যথা হতো। কিন্তু এবার জ্বর তেমন হয় না। গিরায় ও গলায় ব্যথা হয় সামান্য। তবে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হয়। জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথাও থাকে, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাশি থাকে না। ঠিক একইভাবে করোনার উপসর্গও পরিবর্তন হয়েছে।
আগে করোনার উপসর্গ ছিল হাচি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলায় ব্যথা, প্রচণ্ড জ্বর থাকত। এখন জ্বর কম থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টও হয় না। মাথা ব্যথা বেশি থাকে। এদিকে বর্তমানে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মৌসুম। এ কারণে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হলে অনেকে মনে করেন, এটা ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর। তাই চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ঘরে বসে থাকেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, যেহেতু ডেঙ্গু ও করোনা ভাইরাসের আচরণ পরিবর্তন হয়েছে, তাই চিকিৎসার ধরন পরিবর্তন করতে হবে। তবে সবার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে। এদিকে পরীক্ষা করতে হাসপাতালে পর্যাপ্ত কিট নেই। দেশে টিকারও সংকট। করোনা প্রতিরোধে ব্যবস্থাপনা দুর্বল। এয়ারপোর্টে স্যাম্পল কালেকশন তেমন হয় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশে করোনার পরীক্ষার কিটের সংকট। যত দ্রুত রোগ নির্ণয় হবে, তত দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। তাই সারা দেশে চাহিদা অনুযায়ী কিট সরবরাহ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে অনেক মানুষের মাথা ব্যথা ও গিরায় গিরায় ব্যথা থাকলেও জ্বর না থাকায় ঘরে শুয়ে থাকেন। আবার কারো কারোর গিরায় গিরায় ব্যথা থাকে না। যখন জটিলতা দেখা দেয়, ঐ সময় রোগীর জটিলতা বেড়ে গিয়ে আইসিইউর প্রয়োজন হয়। তখন আইসিইউ না পেয়ে মারা যায়। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ডেঙ্গু ও করোনা মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। তাই সময় থাকতে এখন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে স্যাম্পল ক্যালেকশন করতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। পরীক্ষানিরীক্ষার নামে বেসরকারি হাসপাতাল গলাকাটা বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে। সবাইকে সেবার মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে ফি নেওয়া হয় ৭০০ টাকা। আর্টিফিশিয়ার টেস্ট ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে সরকারি হাসপাতালে এই দুটি টেস্ট ফ্রি করা হয়। তবে ফ্রি না দিয়ে একটা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। তখন অযথা হাসপাতালে ভিড় করবে না। মানুষও সচেতন হবে।
ডেঙ্গুতে চলতি বছরের গতকাল পর্যন্ত ২৮ জন মারা গেছে। আর আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৫৭০ জন। মশাবাহিত এ রোগে সবশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা চলতি বছর এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। একই সঙ্গে এ সময়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ১৫৯ জন। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে দেশে করোনায় আরো দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। এ সময় নতুন করে ১৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, বর্তমানে করোনা ও ডেঙ্গুর আচরণগত অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবে এ দুটি রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হলে দ্রুত স্যাম্পল কালেকশন ও রোগ নির্ণয় করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। মশা নিধন করতে হবে। দিনের বেলায় মোজা, ফুল শার্ট পরিধান করতে হবে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে স্যাম্পল কালেকশন করতে পারে। তিনি বলেন, করোনা ও ডেঙ্গু প্রকোপের ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বয়স্ক রোগী, কিডনি রোগী, ক্যানসার রোগী, অ্যাজমা রোগীরা। তাই এখনই এটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সাজাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয়েরই সমন্বয় থাকতে হবে। না হলে পরিস্থিতি যদি ভয়ংকর আকার ধারণ করে, তাহলে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, ডেঙ্গু ও করোনা উভয়ের উপসর্গ পরিবর্তন হয়েছে। করোনার ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তন ও ডেঙ্গুর চরিত্রগত পরিবর্তন হয়েছে। রোগেরও উপসর্গর পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অনেকের কাশি হয়, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ও জয়েন্টে ব্যথা থাকে। গিরায় গিরায় ব্যথা থাকে। এগুলো ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ। আর করোনা রোগী আগের সেই হাচি-কাশি, শ্বাসকষ্ট ও জ্বর থাকত। এর মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কারোর কাশি থাকে, জ্বর থাকে না। এখন কারোর শ্বাসকষ্ট থাকে, আবার কারোর শ্বাসকষ্ট থাকে না। যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, সামনে আরো ব্যাপক হারে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, করোনা গত বছরের এ সময়ে আরো বেশি ছিল। এখন করোনা শুরু হয়েছে। বরগুনায় একটা জলাবদ্ধ এলাকা ছিল, সেখান থেকে মশার বিস্তার ঘটেছে। সারা দেশে করোনা ও ডেঙ্গু রোধে যা যা করণীয় তা করেছি। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় না। মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি। সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক শফি আহমেদ মোয়াজ বলেন, শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গু ও করোনাতে। বাচ্চাদের দিনের বেলায় ফুল হাতা পোশাক ও হাতে-পায়ে মোজা পরতে হবে। সর্দি, কাশি, জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। তিনি বলেন, এ বছর ডেঙ্গু ও করোনার লক্ষণ ও আচারণগত পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে। মশারির মধ্যে ঘুমাতে হবে। শিশুদের রোদে না নেওয়ার পরমর্শ দেন তিনি।
সাননিউজ/ইউকে