জাতীয়
রেমিটেন্সে সচল অর্থনীতি

প্রবাসীদের সমস্যা দূর করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রবাসীদের রেমিটেন্সের ওপরে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা বললে অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার পাশাপাশি নিজ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এই মানুষগুলো যে কী পরিমাণ অমানবিক খাটুনি খাটছেন, সে খবর আর ক’জনই বা রাখি। স্বজনের প্রতি মায়া আর নিজ দেশের মাটির গন্ধ ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা সেই মানুষগুলোর সঙ্কট দূর করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর ভূমিকা নিয়েও রয়েছে বরাবরই প্রশ্ন।

নতুন বছরের প্রথম ১৫ দিনে সেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। রেমিটেন্স এসেছে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। যা অন্য যে কোন বছরের এ সময়ের তুলনায় বেশি।

প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানাযায়, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এসব প্রবাসী শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০১৯ সালে রেমিটেন্স পাঠিয়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার। টাকার অংকে যা দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি। ২০১৮ সালে রেমিটেন্স এসেছিল ১৫ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার । রপ্তানি আয়ে কমে যাওয়ার পরও রেমিটেন্স প্রবাহের ধারা ইতিবাচক হওয়ার কারণে সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

অথচ এই প্রবাসীরা বিভন্ন দেশে শিকার হচ্ছেন হয়রানি ও নির্যাতনের। নির্যাতনের শিকার হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত দেশে ফিরছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সংখ্যাটা। পুরুষদের তুলনায় নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন বেশি। কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নির্যাতনের কারণে অনেকে করছেন আত্মহত্যা। প্রবাসীদের চওড়া কাঁধের ওপর ভর করে জীবনের স্বপ্ন সাজায় দেশে থাকা স্বজনরা। তাদরে পাঠানো সেই রেমিটেন্স নিয়ে আমাদের এত আনন্দ, সেই রেমিটেন্স আসার বাস্তবতার পেছনে রয়েছে নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে রক্ত পানি করা ঘামের গল্প।

সিঙ্গাপুর প্রবাসী নোয়াখালীর বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, মনে মনে ভাবতাম প্রবাসে গেলেই মিলবে সুখ। সেখানে বাতাসে ওড়ছে টাকা। হাত বাড়ালেই ধারা যাবে তা। কিন্তু যাওয়ার সাথে সাথেই সেই ধারনা মিলিয়ে গেল শুণ্যে। সামনে এসে দাঁড়ালো জীবনের কঠিন বাস্তবতা। যাওয়ার পরদিন থেকেই কাজ শুরু। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা। এর পর থেকে শুরু হলো প্রতিদিনের একই রুটিন। সারাদিন কাজ করে বাসায় ফিরে আবারও কাজ। কাপড় পরিষ্কার করা, রান্না বসিয়ে গোসল সেরে নেয়া। খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়িতে ফোন। এত ক্লান্তির পর সবার খোঁজখবর নিতে হয়, তাও হাসিমুখে।

ওমর ফারুক জানান, মাস শেষে পরিবার পরিজনের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়। তা না হলেই বিপর্যয়। প্রায় সব প্রবাসীর জীবন এমন একই ছকে বাধা।

গত বছর সৌদি আরবে কাজ করতে গেলেও দেশটির আবহাওয়া এবং কাজের চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না রানী দাস।

এমন অবস্থায় তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইলেও দূতাবাস থেকে তাকে কোন ধরণের সহায়তা করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তার মতো এমন ছয়জন নারীকে এখন ভিক্ষাবৃত্তি করে খেতে হচ্ছে বলে জানান রানী দাস।

দেশে ফিরতে পারলেও কাজের পুরো পারিশ্রমিক ছাড়াই ফিরতে হয়েছে দিনাজপুরের মোর্শেদা বেগমকে। প্রায় দেড় বছর সৌদি আরবে কাজ করলেও বেতনের মাত্র অর্ধেক তুলতে পেরেছেন তিনি।

"অ্যাম্বাসিওয়ালা মনে করেন জেলখানা থেকেও বেশি কষ্ট দেয়। যে কাজ একবারে করা যায়, ওইটা ঘুরায় ঘুরায় করবে। আমাদের টাকা কেমনে পাব, কোন খোঁজ নেয়না, আমরা কী খাই, কেমনে আছি। বাংলাদেশে তো কল করা যায়না। আমি বাঁইচা আছি না মারা গেছি এইটা বাংলাদেশের কেউ জানেনাই এতদিন।"- বলেন মোর্শেদা বেগম।

এ বিষয়ে দূতাবাসে জনবল নিয়োগে যে মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সেইসঙ্গে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে যথাযথ সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির।

এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে নজর দেয়ার কথা জানান তিনি।

প্রথমত, যে মন্ত্রণালয়গুলো এই দূতাবাসগুলোয় লোক পাঠায়, ঢাকায় তাদের মধ্যে একটা সমন্বয় করা।

বাংলাদেশে এই সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, যারা দূতাবাসে কাজ করতে যাবেন, তাদের জন্য যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

যেন তারা নতুন দেশের, নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও কাজের ধরণের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

যারা এই প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হবেন, শুধুমাত্র তাদেরকেই মিশনে পাঠানোর পরামর্শ দেন তিনি। না হলে এ ধরণের অবাঞ্ছিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরেছেন মোট ৬৪ হাজার ৬৩৮ কর্মী। এর মধ্যে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে ফিরেছেন বেশি।

বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম সান নিউজকে জানান, প্রবাসীদের নির্যাতন বন্ধ করতে নতুন পরিপত্র জারি করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। পাঠানোর চুক্তিতে আনা হচ্ছে নতুন সংশোধনী। কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হলে তাদের সারভার লক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সুমাইয়া ইসলাম আরও জানান, অনেকে দালালের খপ্পরে পরে নির্যাতনের শিকার হন। অনেকে নারী কর্মী আবার ট্রাফিকিং এর শিকার হন। এসব দালালদের বেশিরভাগই ভারত ও শ্রীলঙ্কার নাগরীক।

আরেকটি বড় সমস্য হচ্ছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিকাংশেই অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত। তারা জানেন না সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা কিভারে নিতে হবে। শ্রমিক পাঠানোর আগে নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানাতে বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে নির্যাতনের পরিমাণ কমে আসবে বলে মনে করেন, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম।

২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপিতে রেমিটেন্সের অবদান ছিলো ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে রেমিটেন্স আসার পরিমান বাড়লেও কমেছে জিডিপিতে অবদান, ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে তা আবার বাড়তে পারে বলে ধারণা অর্থনীতি বিশ্লেষকদের।

পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি বছর যে রেমিটেন্স আসে তার মধ্যে ভোগবিলাসে ব্যবহার হয় ৫৩ শতাংশ। অন্যান্য খাতে ব্যবহার হচ্ছে বাকি ৪৭ শতাংশ।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রেমিটেন্স উৎপাদনমুখী খাতে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে আরও দ্রুত গতিতে।

তাদের মতে, রেমিটেন্স বাড়ার অন্যতম কারণ ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়ায় ঘোষণার পর থেকে বাড়ছে রেমিটেন্স আসার পরিমাণ। প্রবাসীরা এখন ১০০ টাকা দেশে পাঠালে দেয়া হচ্ছে ১০২ টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য সূচকের অবস্থা খুব একটা ভালো বলা যায় না। ধস নেমেছে রপ্তানি বাণিজ্যে। কমছে আমদানিও। কাটছে না বিনিয়োগে খরা। কমছে রাজস্ব আদায়। ব্যাংকগুলোতে পাহাড় জমেছে খেলাপি ঋণের। ভালো না শেয়ারবাজারের অবস্থাও। মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বমুখী তো রয়েছেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর বেড়েছে শেয়ারবাজারের সূচক। তবে আস্থা ফিরেনি বিনিয়োগকারীদরে মাধ্যে।

এসবের মধ্যে বিপরীত চিত্র প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত উপার্জন সচল রেখেছে দেশের অর্থনীতির চাকা।

যারা সচল রেখেছে দেশের অর্থনীতির চাকা, তাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে সরকারের প্রতি সুদৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি ও তাদের স্বজনসহ সংশ্লিষ্টরা।

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

লক্ষ্মীপুরে অসহায় মানুষের মাঝে ইফতার বিতরণ 

সোলাইমান ইসলাম নিশান, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি...

স্বাধীনতা দিবস ছাত্রলীগের ইফতার বিতরণ 

সোলাইমান ইসলাম নিশান, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি...

পঞ্চগড়ে মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু 

মো. রাশেদুজ্জামান রাশেদ, পঞ্চগড় প্রতিনিধি:...

ফেনসিডিলসহ ২ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি: মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার বৈ...

পানিতে ডুবে প্রাণ গেল শিশুর

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর সেনবাগে পানিতে ডুবে এক শিশুর...

ভারতের পণ্য বর্জনে সরকার এত বিচলিত কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধানমন্ত্রী শ...

দেশে বছরে অকাল মৃত্যু পৌনে ৩ লাখ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: দূষণের কারণে বা...

বাগদান সারলেন অদিতি-সিদ্ধার্থ

বিনোদন ডেস্ক: ভারতের জনপ্রিয় তারকা অভিনেত্রী অদিতি রাও হায়দা...

আলুর দাম বাড়ার আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের চেয়ে এ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা