হাসনাত শাহীন: দেশের পথনাটকের পথিকৃৎ ও সংস্কৃতি সংগঠক নাট্যকার মান্নান হীরা। নাটকে তিনি তুলে ধরেছেন দেশের নিরন্ন মানুষ ও দরিদ্র জনপদের কথা। যা নিয়েই তিনি বিচরণ করেছেন মঞ্চ, টেলিভিশন ও পথনাটকসহ নাটকের বিভিন্ন শাখায়।
বিগত ২৩ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান নাটকের বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নাট্যকার। তার এই আকস্মিক প্রয়াণে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে দেশের নাট্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণ। তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করতে শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) শুরু হলো ২ দিনব্যাপি স্মরণ উৎসব।
আরণ্যক নাট্যদলের আয়োজনে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলটির প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক মান্নান হীরার স্মরণ উৎসবের আয়োজন। উৎসবের শিরোনাম ‘নাটক আমার প্রিয় ভূমি, আমার জীবন মরণ’।
এ উপলক্ষে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা ভবনের চিলেকোঠায় অনুষ্ঠিত হয় উৎসবের উদ্বোধনী আয়োজন। এতে দুই দিনব্যাপি এই উৎসবের উদ্বোধন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এসময় উপস্থিত ছিলেন নাট্যব্যাক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী, পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ গিয়াসসহ নাট্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমাদের নাট্যঙ্গনে যখন দীর্ঘসময় ধরে একটা শুন্যতা বিরাজ করছিল ঠিক সেই সময় মান্নান হীরার মত নাট্যজন সেই শুন্যতা পূরণ করেছিল। মান্নান হীরা আমার খুব স্নেহভাজন ছিল। আমরা একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি।
দেশের পথ নাটক আন্দোলনে মান্নান হীরার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, তার চলে যাওয়াতে আবার সেই শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে সকাল ১১ টায় জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। সেমিনারে ‘মান্নান হীরা এবং তার ট্রিলজি’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করেন অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী।
লিখিত বক্তব্যে রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘মান্নান হীরার পথনাটক প্রকৃত সত্যউচ্চারণ সম্ভার। তার পথনাটক সমসাময়িক আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়কে অঙ্গিভূত করেছে এবং তার পথনাটক যতটা না শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ তার চেয়ে অনেক বেশি অধীনত মতাদর্শ প্রচার ও সংগ্রামের হাতিয়ার।’
নাট্যব্যাক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, এটা শোক সভা নয় আমরা নাম দিয়েছি স্মরণ উৎসব কারন হীরাতো বিগত হয় নি আমাদের কাছ থেকে। সে বেচেঁ আছে তার লিখনিতে।
তিনি বলেন, 'হীরা বেচেঁ ছিল ৬৪ বছর। এই বয়সের মধ্য দিয়ে তার নানা রকমের কাজ আমরা দেখেছি। একটাতো পথনাটকের কথা সবাই বলছেন। আসলেই সে বাংলাদেশের পথনাটককে সার্বজনিন করেন। সারাদেশে পথনাটক ছড়িয়ে দেয়ার যে ভূমিকা সেটা অসাধারণ।'
এরপর জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে সন্ধ্যা ৭টায় দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত হয় মান্নান হীরা’র রচিত নাটক ‘ময়ূর সিংহাসন’। এ নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন শাহ আলম দুলাল।
শনিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি উৎসবের শেষ দিন বিকেল ৪ টায় শিল্পকলা একাডেমির কফি হাউস সংলগ্ন খোলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে পথ নাটক উৎসব। এতে উৎস নাট্যদল পরিবেশন করবে ‘ইঁদারা’, আরণ্যক নাট্যদল পরিবেশন করবে নাটক ‘মূর্খ লোকের মূর্খ কথা’ ও ‘ঘুমের মানুষ’, থিয়েটার অঙ্গন দেখাবে তাদের প্রযোজনার পথনাটক ‘ফুলেশ্বরীর কাব্যগাঁথা’ এবং সুবচন নাট্য সংসদ পরিবেশন করবে পথনাটক ‘বৌ’।
প্রসঙ্গত, দেশের বিশাল কৃষিজীবী মানুষ, তাদের উৎপাদন ও উপকরণ কেন্দ্র করে লেখা তীক্ষè সংলাপের ঘাত-প্রতিঘাতে মান্নান হীরার নাটক যেমন অভিনয় উপযোগী, তেমনি সুখপাঠ্য। প্রচ্ছন্ন রাজনীতিকে কেন্দ্রে রেখে প্রেম ও অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক আবর্তিত হয় তার নাটকে। প্রথাগত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে ফেলতে অনুপ্রেরণা জোগায় তার লেখা নাটক। তিনি প্রায় ১৫টি নাটক লিখেছেন।
উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোমধ্যে আছে লাল জমিন, ভাগের মানুষ, ময়ূর সিংহাসন, সাদা-কালো ইত্যাদি। মূর্খ লোকের মূর্খ কথা মান্নান হীরা রচিত ও নির্দেশিত অন্যতম পথনাটক। ২০০৬ সালে তিনি নাটক শ্রেণিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
সান নিউজ/আরআই