মোহাম্মদ রুবেল: আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বর্তমানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতির হাতেখড়ি তার। ছাত্রজীবনের রাজনীতির সিঁড়িবেয়েই উঠে এসেছেন রাজনীতির জাতীয় মঞ্চে।
নাছিমের হাত দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কৃষিবিদ হিসেবেও পরিচিত এ রাজনীতিক। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সহকারীও ছিলেন একসময়। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে টানা তিনবার সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বিরোধী দলে থাকাকালীন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কারাভোগও করেছেন। সম্প্রতি সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুখ খুলেছেন সান নিউজে।
সান নিউজ: মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কতটা প্রভাব ফেলবে?
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম: মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান, রোহিঙ্গা সংকট, ভূ-রাজনীতি এবং দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খুববেশি প্রভাব ফেলার সুযোগ নেই। আমরা অতীতেও দেখেছি এ ধরনের কোন ঘটনাই খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নাই। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই তাদের দেশে ফেরত যেতে হবে। তাদের নিয়ে আমাদের কোন রাজনীতি করার কোন ইচ্ছা নেই। আমরা চাই তারা তাদের দেশে ফিরে যাক। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ওদের অভ্যুত্থান কোন বাধা নয়। আর যদি সামরিক অভ্যুত্থান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেটা হবে খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
মিয়ানমারে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় সেক্ষেত্রে দেশটির জনগণের পাশপাশি আমরা সুফলের ভাগীদার হতে পারবো। কিন্তু কুফলের ভাগীদার হইনা ওই ক্ষেত্রে। কারণটা কি? কারনটা হলো এই যে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে সূ চিসহ আরও অনেককে গ্রেফতার করা হলো। ফলে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের দরজা কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল। একটা সময় মিয়ানমার কিন্তু বসে থাকেনি। তারাও রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল। আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানে সেটা এখন বন্ধ হয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতিতে স্থবিরতা আসবেই। এমনিতেই মিয়ানমার যা বলে তা করে না। বলে একটা করে আরেকটা, যা বিশ্বাস করে তাও বলে না। এগুলো কিন্তু মিয়ানমারের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চলে আসছে। এগুলো সারাবিশ্ববাসী জানে, আমরাও জানি এবং দেখে আসছি।
নাছিম বলেন, যাদেরকে আমরা সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ও উদার ভাবতাম সেইতো রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের জন্য তেমন কিছুই করে নাই। আর যারা মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালো তারা কি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কোনো আলোচনায় আসবে? আমারতো মনে হয় আসবে না। তবুও আশাকরি, তারা জাতিসংঘ, বিশ্ববাসী ও আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সকল ব্যবস্থা করবে। রোহিঙ্গারাও নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে নিজ ভূমিতে ফিরে যাবেন আমাদের সরকার এই প্রত্যাশাই করে।
সান নিউজ: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার ব্যর্থতার অভিযোগে আসন্ন ইউপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। সবমিলিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনে অংশ নেয়া কতটা গুরুত্ব বহন করে বলে আপনি মনে করেন ?
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম: নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করা নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জয়ের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জনগণের সমর্থন আদায় করতে না পারলে সরকারে যাওয়া যাবে না, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া যাবে না। জনগণের কল্যাণে, জনগণের জন্য কর্মসূচি দিতে হবে।
কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বিএনপি কখনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আবার অংশগ্রহণ না করার ঘোষণার উদ্দেশ্য মূলত সবকিছুকে বাধাগ্রস্ত করা। নেতিবাচক জায়গায় পৌঁছে দেয়া, বিতর্ক সৃষ্টি করা এবং এর ভেতর দিয়ে বিরাজনীতিকরণকে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আমি মনে করি, দলটির এই প্রচেষ্টা সফল হবে না। কারণ জনগণের সমর্থন আদায়ে বিএনপি-জামায়াত ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত যেমন সব কর্মকাণ্ডকে বিতর্কিত করতে চায়, এখন আবার মাঠে তাদের সহশক্তি হিসেবে কাজ করছে সুশীল সমাজ নামক কিছু বুদ্ধিজীবী। সস্প্রতি এসব বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছে। যা মূলত রাজনৈতিক স্বার্থেই করেছে। এটা রাজনৈতিক প্রচার। উদ্দেশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা নয়। তাদের উদ্দেশ্যে যদি ভাল হত তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশনকে দিতে পারতেন।
সান নিউজ: বিরোধীদের অভিযোগ দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক স্বাধীনতাও নেই। অনেকেই আবার বলছেন দেশে শক্তিশালী বিরোধীদল নেই। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সেনা ছাউনি থেকে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনে অবরুদ্ধ, বন্দি গণতন্ত্রকে আমরা মুক্ত করেছি। অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আর এখন আমরা দেশের মানুষের ভোটের অধিকার ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। গণতান্ত্রিক অধিকার এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে জনগণ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের পরিবর্তন আনবে। জনগণ যাকে চাইবে, তিনিই দেশ পরিচালনা করবেন এটাই আমাদের লক্ষ্য। আওয়ামী লীগের সবসময় শেষ ভরসার জায়গা জনগণ। জনগণই মূল শক্তি। জনগণ যাকে চাইবে না তিনি দেশ পরিচালনা থেকে দূরে সরে যাবেন।
তিনি বলেন, সরকার, বিরোধীদল এবং সিভিল সোসাইটিকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। বিরোধীদলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে জনগণকে সংগঠিত করে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য অংশগ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করা নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জয়ের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জনগণের সমর্থন আদায় করতে না পারলে সরকারে যাওয়া যাবে না, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া যাবে না। জনগণের কল্যাণে, জনগণের জন্য কর্মসূচি দিতে হবে।
নাছিম বলেন, জনসম্পৃক্ততা ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে গণঅভ্যুত্থান করা সম্ভব নয়। তাই মানুষকে আশ্বাস দিতে হবে, বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে। ভরসার জায়গাটা যখন তৈরি হবে তখনই মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দেবে। কিন্তু বিএনপিতে সে ধরণের কোনো প্রচেষ্টা নেই। তাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। তারা চান যেন তেন পন্থায় ক্ষমতায় যেতে। উনারা চান সাম্প্রদায়িক শক্তির জাগরণ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকুক বা না থাকুক, তাদের কিছু আসে যায় না। ক্ষমতাই তাদের কাছে মুখ্য। তাই তারা চোরাগুপ্তা পথে অগণতান্ত্রিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। বিদেশি প্রভুদের ওপর তারা নির্ভর করে। ক্ষমতায় আসার জন্য বিদেশি প্রভুদের কাছে ধর্ণা দেয়। অথচ জনগণের কাছে যায় না। কিন্তু জনগণের কাছেই তাদের ধর্ণা দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
বাক স্বাধীনতার বিষয়ে নাছিম বলেন, বিরোধীদলে যারা আছেন তারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। কিন্তু তারা কী করতে পারবেন বা অতীতে কী করেছেন সেটা নিয়ে ভাবেন না। অতীতের অপকর্মের জন্য তাদের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তারা যদি ভালো কোনো কর্মসূচি দেয়, জনগণ যদি সেই কর্মসূচিতে সমর্থন দেয় তাহলে তারা নির্বাচিত হবে। সরকারে আসবে। আমাদের তো এখানে দেখার কিছু নেই, বাধা দেয়ারও কিছু নেই। আমরা তাদের স্বাগত জানাব। কিন্তু তাদের সঠিক পথে হাঁটতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষ, হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান একসঙ্গে মিলেমিশে আছি। এটা আওয়ামী লীগের দর্শন এবং জাতির পিতার আদর্শ। এ আদর্শ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও কল্যাণমুখী বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখনও কাজ করে যাচ্ছে এবং কাজ করে যাবে। এটাই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা।
সান নিউজ: বারবার হুশিয়ারী, বহিষ্কার করেও বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকানো যাচ্ছে না কেন ? কি ব্যবস্থা নিলে চূড়ান্তভাবে এদের দমন করা যাবে ?
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম: আসলে ব্যক্তি স্বার্থের বাইরে কিছু নেই। ব্যক্তিস্বার্থ অবশ্যই থাকে। আর এজন্য দেখা যায়, আমাদের নেত্রীর সিদ্ধান্তকে অনেকে অমান্য করে। তিন বা ততোধিক প্রার্থীর নাম পাঠানোর জন্য বলা হলেও, কেউ কেউ একজনের নাম পাঠান। শেষ পর্যন্ত দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহীরা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর এই বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে থাকেন আমাদের পার্টির অনেক স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বঞ্চিত হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে।
সান নিউজ/এমআর/এসএস