খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে (ছবি: সংগৃহীত)
মতামত

দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী, চিড়েচ্যাপ্টা জনতা

মনজু আরা বেগম: দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতিতে চিড়েচ্যাপ্টা আমজনতা। পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দুরবস্থার কথা নিয়ে লেখা হচ্ছে। কিন্তু এসব লেখালেখিতে আদৌ কোনো কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন ‘কানে দিয়েছে তুলো আর পিঠে বেঁধেছে কুলো’। দ্রব্যমূল্যের বর্তমান বাজার দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও ছা-পোষা কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রেণির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এর ওপর জেঁকে বসেছে করোনার অভিঘাত। জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো ধুঁকে ধুঁকে চলছে জীবনের গতি। বছরের এ সময়টাতে নতুন ধান নামে, নবান্নের উৎসবে মেতে ওঠে গ্রামগঞ্জের মানুষ। সেই সঙ্গে বাজারে ওঠে শীতকালীন শাকসবজি। কিন্তু এখন এ সবকিছু চলে গেছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সেই যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ধোয়া তুলে বাজার গরম হয়েছে, তা আর যেন কিছুতেই ঠাণ্ডা হচ্ছে না।

ফলে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। টান পড়েছে ঘরের বাজেটে। বেঁচে থাকার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য-চাল, ডাল, তেল, নুন কিনতেই যদি নাভিশ্বাস ওঠে, তাহলে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনীয় ওষুধ, ডাক্তার বা হাসপাতালের ব্যয় মেটানো হবে কোথা থেকে? করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাই বা হবে কীভাবে? চোখের সামনে আপনজনের ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু দেখতে হবে? হ্যাঁ, এটা সত্য, আমাদের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু কাদের বেড়েছে? কোন শ্রেণির মানুষের বেড়েছে? যেটুকু বেড়েছে সেটুকু যদি বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যায় তাহলে চিকিৎসা, শিক্ষা, বাড়িভাড়া, পানি, বিদ্যুৎসহ অপরিহার্য দ্রব্যাদির ব্যয় নির্বাহ হবে কিভাবে?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমরা অনেক তথ্য জানতে পারি এবং সেই সঙ্গে অনেক কষ্ট, ব্যথা-বেদনা শেয়ার করতে পারি। তেমনি একজন চাকরিজীবীর দৈনন্দিন জীবনের খেরো খাতা দেখতে পেলাম ‘বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরাম’ থেকে। এ ফোরামে এক ভাই লিখেছেন, রাজধানীর কাওরান বাজারে অবস্থিত বিমা কোম্পানির এক চাকরিজীবী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের, তার জীবন এখন আর চলছে না।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধিতে বিগত ছয় মাস ধরে তিনি অত্যন্ত বিপাকে পড়েছেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও মাকে নিয়ে রাজধানীর হাজারীবাগে থাকেন। বেতন পান ৫০ হাজার টাকা। এই টাকার মাসিক খাতওয়ারি খরচের পুঙ্খানুপুঙ্খ একটি হিসাব দিয়েছেন। এ হিসাবটি হুবহু সবার জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি। তিন রুমের একটি বাসায় তারা স্বামী স্ত্রী, তিন সন্তান এবং তার মা থাকেন।

ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ পড়ে। বাসাভাড়া দেন ১৬ হাজার টাকা। অফিসে যাতায়াত খরচ ৩ হাজার, তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ৮ হাজার, মায়ের ওষুধ ৮৫০, পত্রিকা বিল ১৫০, পানির বিল ৫০০, গ্যাস বিল ৯৭৫, বিদ্যুৎ বিল ৮০০, ডিশ ও ইন্টারনেট ১১০০, একটি ডিপিএস ১০০০ টাকা, ময়লা পরিষ্কার ১২৫, কাজের বুয়া ২০০০ টাকা। অর্থাৎ ফিক্সড খরচ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা। ৫০ হাজার টাকার মধ্যে বাকি ১৫ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কোনোরকমে এতদিন টেনেটুনে সংসার চলছিল। উল্লেখ্য, তিনি তার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী বা নিজের চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক কোনো ব্যয় এখানে দেখাননি।

ছয় সদস্যের এ পরিবারটিতে বাকি ১৫ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে দুর্মূল্যের এই বাজারে তিন বেলা ডাল-ভাতও কি খাওয়া সম্ভব? ২০২০ থেকে চলতি সময় পর্যন্ত চাল, ডাল, তেল, নুন, আটা, ময়দা, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, ওষুধ, শিক্ষাসামগ্রীসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যার মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়নি।

উপরোক্ত হিসাব অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকায় যদি একটি সাধারণ মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করা কষ্টসাধ্য হয়, তাহলে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন কিভাবে অতিবাহিত হচ্ছে, তা কি সরকার বা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ সংশ্লিষ্টরা একবারও ভেবে দেখছেন? সাধারণ মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব করার জন্য সরকার টিসিবির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে কিছু পণ্য সরবরাহ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই পণ্য ক্রয়ের জন্য বিভিন্ন স্তরের মানুষ যেভাবে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, তাতে করে এত যুদ্ধ করে তা ক্রয় করাও সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

সরকার ২০১৫ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল নির্ধারণ করে বেতনভাতা বেশ কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে। এতে সরকারি চাকরিজীবীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে বাজার ব্যবস্থা নিয়ে। বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পুরো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়িভাড়া, চিকিৎসার উপকরণ, শিক্ষার উপকরণ, বিদ্যুৎ বিল, পরিবহণ ব্যয়, পানির বিল, গ্যাসের বিলসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুই। আসছে রমজান এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। রমজান ও বাজেটকে কেন্দ্র করে আরেক দফা দাম বাড়বে এটা নিশ্চিত। জানা গেছে, আগামী বাজেটে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন বিল বৃদ্ধির চিন্তাভাবনা করছে সরকার। তাহলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

চিকিৎসা ব্যয় এখন বিলাস ব্যয়ে পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ২০ বছর মেয়াদি (২০১২-২০৩২ সাল) একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। এতে বলা হয়েছে, ব্যক্তি পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যয় পর্যায়ক্রমে কমিয়ে ২০৩২ সালে ৩২ শতাংশ করা হবে। বাকিটা সরকার বহন করবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যয় তো কমছেই না, বরং দিন দিন তা বাড়ছে। ২০২০ সালে এ ব্যয় বেড়ে ৬৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ তথ্য থেকে স্পষ্টভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে পড়ছে।

২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট কৌশলপত্র প্রণয়নের সময় ব্যক্তির নিজস্ব চিকিৎসা ব্যয় ছিল ৬৪ শতাংশ। ২০১৫-২০১৭ সালে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ শতাংশে। ২০২০ সালের গবেষণায় এ ব্যয় আরও বেড়ে হয়েছে ৬৮.৫ শতাংশ। তাই করোনাকালীন চিকিৎসা খরচ বহনে প্রবীণ নারী-পুরুষসহ সাধারণ মানুষ আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৭ সাল থেকে দেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে না বেড়ে বরং কমে আসছে। এতে হিমশিম খাচ্ছে রোগীর পরিবার।

২০১৭ সালের স্বাস্থ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় মালদ্বীপে ১৮, ভুটানে ২৫, শ্রীলংকায় ৪২, নেপালে ৪৭, পাকিস্তানে ৫৬ ও ভারতে ৬২ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে এ ব্যয় সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৬৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশেই ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে বেশি। এ কারণে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার কারণে দেশে পরিবারপ্রতি গড়ে ৪ হাজার টাকা করে আয় কমে গেছে। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ দিনমজুর কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, একশ্রেণির মানুষের আয়ের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। করোনাকালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকলেও বিগত এক বছরে দেশে নতুন কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজারে। এর সঙ্গে বেড়েছে অর্থপাচারের হার।

গত বছরের নভেম্বরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে তার ভাষণে বলেছিলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করাই এখন মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে সরকারকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হয়। সেজন্য রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলতে হবে। কারণ উন্নয়নের ফসল অনেকটাই খেয়ে নেয় দুর্নীতি। ফলে সাধারণ মানুষ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়।

আরও পড়ুন: ইউক্রেন সংকটে দক্ষিণ এশিয়ায় যে প্রভাব পড়তে পারে

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাস্তবায়ন করতে হলে অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। মাথাপিছু আয়, উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছাতে না পারলে তা দেশের আমজনতার সার্বিক কল্যাণে কখনোই আসবে না। তাই সাধারণ মানুষের বর্তমান দৈন্যদশা থেকে মুক্তির জন্য শক্ত হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সার্বজনীন পেনশন সুবিধা দ্রুত চালু করা প্রয়োজন।

মনজু আরা বেগম : লেখক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক।

সাননিউজ/এমএসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ভালুকায় ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ২

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের ভালুকায় তীর কোম্পানি...

বোয়ালমারীতে বজ্রপাতে আহত ৮

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে প...

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অত...

ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ

স্পোর্টস ডেস্ক : আসন্ন বিশ্বকাপের প্রস্তুতি...

গজারিয়ায় পুলিশ-সাংবাদিককে মারধর

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ: উপজে...

ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়াল

নিজস্ব প্রতিবেদক : ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বা‌ড়িয়ে ১১...

রংপুরে নিম্নমানের স্যালাইনে বাজার সয়লাভ 

রংপুর ব্যুরো: সারা দেশের মতো রংপু...

ধানের বাম্পার ফলনেও শঙ্কায় কৃষক

রংপুর ব্যুরো: নানা প্রতিকূলতার মধ...

চীনে ছুরি হামলায় ১০ জনের মৃত্যু

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চীনের ইউনান প্রদেশের জেনসিয়ং কাউন্টির এক...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা