হুমায়ূন আহমেদ
শিল্প ও সাহিত্য
হুমায়ূন আহমেদ

বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাটের জন্ম

সান নিউজ ডেস্ক: হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনের এক কালজয়ী নক্ষত্রের নাম। এক কালজয়ী মানুষের নাম। যখন গল্প লিখেছেন মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন, যখন তার কলম থেকে উপন্যাস ঝড়েছে তখনও তিনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন।

নাটক নির্মাণ করেছেন মানুষ সেখানেও ভালবেসে রাস্তায় নেমে গেছে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সেখানেও মানুষ ভালবেসে সিনেমা হল কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে।

যখন যেখানে কলম চালিয়েছেন, নিজের সোনালী হাতের স্পর্শ দিয়েছেন, সেটাই বাংলার মানুষ গ্রহণ করেছে পরম মমতায়, পরম ভালবাসায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। তিনি দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর বাংলার পাঠক সমাজকে নিজের কলমের জাদুতে এক রকম মোহবিষ্ট করে রেখেছিলেন।

জাদুকর যেমন তার হাতে থাকা কালো ছড়ি বা, লাঠি ঘুরিয়ে দর্শকদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায়, হুমায়ূন আহমেদও তেমনি নিজের হাতে থাকা কালো কলমটি সাদা কাগজের উপর ঘুরিয়ে আমাদের বারবার অন্য জগতে নিয়ে গেছেন।

তিনি একাধারে রচনা করেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক এবং গান। প্রথম উপন্যাসেই বাজিমাত করা লেখকের দেখা পাওয়া গোটা পৃথিবীতেই অনেক দুষ্কর। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তাদেরই একজন।

১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হলে সেটিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি তার জীবনকালে ২০০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। মজার বিষয় তার সব বই’ই বাংলাদেশের বেস্ট সেলার বা, সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের স্বীকৃতি প্রাপ্ত।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া গ্রামের কুতুবপুর উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তার পারিবারিক ডাক নাম ছিল কাজল। ছোটবেলায় হুমায়ূন আহমেদ খুব ভাল ছাত্র ছিলেন না। তবে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হুমায়ূন আহমেদের পড়াশোনার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হতে থাকে।

তারই ফলস্বরুপ এস এস সি পরীক্ষার রেজাল্টের পর দেখা গেলো তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২য় স্থান অধিকার করেছেন। এইচ এস সিতেও তিনি মেধা তালিকায় খুব সহজেই স্থান করে নেন।

ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করে প্রথমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।

পরবর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের রসায়ন বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এমনকি আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার সায়েন্সেও পি এইচ ডি রয়েছে এই কালজয়ী লেখকের।

পরবর্তিতে এই কলম জাদুকর তার লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অধ্যাপনা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন। যদিও শিক্ষক হিসেবেও নিজের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাসের নাম ‘নন্দিত নরকে’। উপন্যাসটি ১৯৭১ সালে প্রকাশের কথা থাকলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণে তা ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। তার ২য় গ্রন্থ ‘শঙ্খনীল কারাগার’।

তিনি বাংলা উপন্যাসে সম্পূর্ণ নতুন করণকৌশল নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। বাংলা উপন্যাসকে দেখিয়েছিলেন নতুন দিক। বাংলা উপন্যাস দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের কথা সাহিত্যিকদের হাতে পরিপুষ্ট হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদ প্রায় একাই সেই শতবর্ষের ঋণ এপার বাংলা থেকে মিটিয়ে দিলেন। একা বাংলা সাহিত্যের রাজত্ব কলকাতা থেকে টেনে বাংলাদেশে নিয়ে আসলেন।

হুমায়ূন আহমেদ গল্পের প্রাণ ছিল পাত্র পাত্রীদের মিথস্ক্রিয়া। তাদের ছোট ছোট সংলাপকে প্রাধান্য দিয়ে গল্প লিখতেন হুমায়ূন আহমেদ।

অতি সাধারণ কথাকে অসাধারণভাবে প্রকাশের এক অন্যরকম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন এই লেখক। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, ইউরোপীয় আদলের বাইরে গিয়েও সফল এবং গুনগত মানসম্পন্ন উপন্যাস সৃষ্টি সম্ভব।

অতিবাস্তব ঘটনাবলিকে অতি বিশ্বাসী করে উপস্থাপনের অতিরিক্ত রকমের এক ক্ষমতা ছিল তার। তার লেখনীর এই ধরনকে ম্যাজিকাল রিয়ালিজম বা, জাদু বাস্তবতা ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়ে থাকে।
হুমায়ূন আহমেদের রচনাতে নেতিবাচক চরিত্রও অনেক সময় লাভ করে দরদী রুপায়ণ। ধরা হয় এ বিষয়ে তিনি মার্কিন লেখক স্টেইনবেক দ্বারা প্রভাবিত।

১৯৯০ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিবারের একুশে বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক ছিলেন তিনি। শুধুমাত্র এ ঘটনাটিই তার তুমুল পাঠক প্রিয়তার এক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

হুমায়ুন আহমেদ এর বেশ কিছু বই বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তার বেশ কিছু গল্প স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচিরও অন্তর্ভুক্ত।

বাংলার যুবকদের উপর হুমায়ূন আহমেদের ছিল জাদুকরি এক প্রভাব। তার সৃষ্ট চরিত্র হিমুকে অনেক সময় লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় মনে করা হয়ে থাকে। অনেক যুবকই তাদের কৈশরের কোন না কোন সময়ে নিজেকে হিমু হিসেবে কল্পনা করে থাকে।

হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি, খালি পা, ভবঘুরে জীবন যুবকদের দারুণভাবে উদ্বেলিত করেছিল। এছাড়াও মিসির আলীর মত রহস্যময় চরিত্র, শুভ্রর মত অতি পবিত্র চরিত্র এবং রুপার মতো মায়াবতী প্রেমিকা হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলোদের মাঝে অন্যতম। আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃতও তিনি।

তার রচিত ‘তোমেদের জন্য ভালবাসা’ তার প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। টেলিভিশনে প্রচারের জন্যও বেশ কিছু নাটক এবং টেলিফিল্ম রচনা করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম টিভি নাটক ‘প্রথম প্রহর’ তাকে সারাদেশে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে।

এছাড়াও এসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, তারা তিনজন, উড়ে যায় বকপক্ষী এমন বেশ কিছু অত্যন্ত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকের রচয়িতা তিনি।

তার নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’তে প্রধান চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হলে সেই ফাঁসি বন্ধে সারা দেশের মানুষ মিছিল নিয়ে নেমে পড়েছিল। ঢাকার গলিতে গলিতে পোস্টার লাগানো হয়েছিল।

একজন মানুষের সৃষ্টি কতটা প্রভাব বিস্তার করলে এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। মৃত্যুর পর তার নির্মিত ধারাবাহিক নাটক আজ রবিবার ভারতের বিখ্যাত চ্যানেল স্টার প্লাসে হিন্দীতে ডাবিং করে বর্তমানে প্রচারিত হচ্ছে।

বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি একাধারে চলচ্চিত্রকার এবং পরিচালক। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘আগুনের পরশমনি’। তার ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে একটি।

তার ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিল।

তার পরিচালনায় সর্বশেষ সিনেমা ছিল ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। তার সিনেমাগুলো বেশ কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বেশ কিছু বিভাগে পুরস্কার জিতেছিল। তিনি সেভাবে গান রচনা করতেন না।

শুধুমাত্র নিজের সিনেমা এবং নাটকের জন্যই তিনি গান রচনা করতেন। তার সিনেমাগুলোর সব গানই মোটামুটিভাবে তিনি নিজেই রচনা করতেন। গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল সেসময়।

হুমায়ূন আহমেদ তার জীবনে দুবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে তার প্রথম বিবাহ হয়। তার প্রথম স্ত্রীর নাম গুলকেতিন আহমেদ। পরবর্তিতে.২০০৫ সালে তিনি তার ১ম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফের বিয়ে করেন।

তিনি মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি কিছুটা অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন। তার ৯০ বিঘা জমির উপর স্থাপিত এক বাগানবাড়ি আছে। বাগানবাড়িটির নাম নুহাশপল্লী। তিনি সেখানেই থাকতে ভালবাসতেন।

তিনি তার জীবনে বহু সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এই নন্দিত লেখক ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে অন্য ভূবনে চলে যান।

আজ বাংলা সাহিত্যের এক নতুন সূর্য মুকুটহীন সম্রাট হুমায়ূন আহমেদ এর জন্মদিন। আজকের এই দিনে সান নিউজ পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সূত্র: তক্ষশীলা

সান নিউজ/এফএইচপি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নেত্রকোনা–৩ আসনে মনোনয়ন পেলেন মাওলানা শেখ শামছুদ্দোহা

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেত্রকোনা–৩ (কেন্দুয়া–আটপাড়া)...

বিজয় দিবসের আগের রাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন

শরীয়তপুর সদর উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন দেওয়ার ঘ...

নোয়াখালীতে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া মাহফিল

মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) রাতে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্র...

সাংবাদিক অ্যাওয়ার্ড পেলেন কুদরতে খোদা সবুজ

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গুণী সাংবাদিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন দেশের দশম সংবাদভিত্তি...

রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ডে প্রথম হলো ইসলামী ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়...

কুষ্টিয়ায় শীতার্তদের মাঝে বিজিবির শীতবস্ত্র বিতরণ

কুষ্টিয়ার মিরপুরে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ...

নোয়াখালীতে গাড়ির গ্যারেজে ঝুলছিল চালকের মরদেহ

নোয়াখালীর সেনবাগে গ্যারেজ থেকে এক চালকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ...

এবার তারেক রহমান নিজেই জানালেন দেশে ফেরার তারিখ

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবার এক ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন,...

ছেঁড়া নোটের ৯০%  অক্ষত থাকলে মিলবে পুরো মূল্য

বাংলাদেশে ছেঁড়া, ফাটা ও ত্রুটিযুক্ত টাকার নোট বিনিময়ে নতুন নীতিমালা জারি করেছ...

রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ডে প্রথম হলো ইসলামী ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা