বিভুরঞ্জন সরকার
মতামত

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং জনদুর্ভোগ

বিভুরঞ্জন সরকার

হঠাৎ করে কোনো আগাম ঘোষণা না দিয়ে সরকার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়িয়েছে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা। ৬৫ টাকার তেল এখন হয়েছে ৮০ টাকা। ‘রয়েসয়ে’ বলে বাংলা ভাষায় একটি কথা আছে। একবার বড় ধাক্কা সামাল দেওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই সহনীয় মাত্রা বিবেচনা করা দরকার। অনেক বছর থেকে দাম বাড়ানো হয় না বলে একবারে ডিজেল-কেরসিনের দাম এতটা বাড়ানো হয়েছে যার ধাক্কা সামাল দেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছে।

দাম বাড়ানোর পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় গত ৫ মাসে সরকারের হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। আর লোকসান গোনা সম্ভব নয়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার বুঝি ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা কোনো কিছু কেনার দাম বাড়লে বিক্রির দামও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয়। এমনকি আগের কেনা পণ্যের দাম বাড়ার খবর শুনলেও দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নেওয়া জাত ব্যবসায়ীদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার।

একবার দাম বাড়িয়ে আবার কমানোর অতীত কোনো নজির না পাওয়ায় এটা মনে হচ্ছে তেলের দাম আর কমবে না। কয়েকদিন এ নিয়ে কিছুটা উত্তাপ-উত্তেজনা থাকবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের দেশের মানুষের ধৈর্য ক্ষমতা অসাধারণ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলেও বেঁচে থাকার ইচ্ছা আঁকড়ে থাকে। তবে মানুষের জীবন নিয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করাই ভালো।

কিন্তু সরকার তো আর ব্যবসায়ী নয়। সব ব্যাপারে লাভক্ষতির টাকাআনাপাই হিসাব করে সরকার চলতে পারে না। দেশের মানুষের প্রতি সরকারের দায়দায়িত্ব থাকে। মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে অনেক সময় ভর্তুকিও দিতে হয়। কৃষকদের উৎপাদন বাড়ানোর কাজে উৎসাহ জোগাতে সার,বীজসহ কৃষি উপকরণে বর্তুকি তো বর্তমান সরকারও দিয়েছে। তাহলে এবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে তেলের দাম এতটা বাড়ানো হলো কেন?

এই দাম বাড়ানোর জন্য যে সাধারণ মানুষের জীবনে কত বড় দুর্ভোগ নেমে আসবে, তা কি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনায় নিয়েছেন? হয়তো বলা হবে, এভাবে লোকসান গুনতে হলে তো সরকারের উন্নয়ন তৎপরতা ব্যাহত হবে। সরকারকেও তো সরকারের ভালো মন্দ ভাবতে হবে। কথা মিথ্যা নয় । কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছিল, তখন তো সরকার দাম কমানোর কথা ভাবেনি। গত কয় বছরে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ ঘরে তোলা হয়েছে তা থেকে ভর্তুকি দিয়ে কি সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমানো যেতো না? নাকি সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করা সরকার আর জরুরি মনে করছে না?

তেলের দাম বাড়ানোর অনেক প্রতিক্রিয়া আছে। এর প্রভাব বহু বিস্তৃত। দাম বাড়ার ঘোষণা শুনেই দেশে কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই বাস-ট্রাকসহ তেল চালিত পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এতে মানুষের জন্য দুঃসহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মানুষ এই অবস্থার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কয়দিনের ধর্মঘটে কত মানুষ কতভাবে কত রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, তা জানাবোঝার চেষ্টা কি একবার সরকার করে দেখবে? পরিবহন মালিকরা তো প্রতিদিনই লাভ করেন। ধর্মঘটের জন্য ২/৪ সময় দিয়ে নোটিশ দিলে এমন ক্ষতি কি হতো যার জন্য পরিবহন মালিকদের অনাহারে থাকতে হতো?

দাম বাড়িয়েছে সরকার। তাহলে সরকারের ওপর চাপ তৈরির উপায় বের না করে সাধারণ মানুষের ওপর দুর্বিষহ অবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হলো কেন? সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে পরিবহন মালিকদের এই আচরণ নিন্দনীয়ই শুধু নয়, বরং এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সরকার পরিবহন মালিকদের শায়েস্তা না করে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে পরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে বেপরোয়া মালিকদেরই স্বার্থ রক্ষা করলো। এতে কি সরকারের জনবান্ধন রূপ ফুটে উঠলো?

শুধু বাস বা লঞ্চ কিংবা ট্রাকের ভাড়া বাড়ানোর প্রভাব পড়বে বাজারে। নিত্যপণ্যের বাজার গত কয়েক মাস ধরেই অস্থির। সব জিনিসের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এখন পরিবহন ভাড়া বাড়ার অজুহাতে আরেক দফা দাম বাড়বে সব জিনিসপত্রের। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। মূল্যস্ফীতি ঘটবে। বাজার এবং পরিবহন খাতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে সব ধাক্কা যাবে ভোক্তা তথা সাধারণ মানুষের ওপর দিয়ে। প্রশ্ন হলো, মানুষের কি এত ধাক্কা সামাল দেওয়ার অবস্থা আছে?

গত পৌনে দুই বছরে করোনার কারণে এমনিতেই দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবন নানা কারণে অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। অনেক মানুষ আয়-উপার্জনহীন হয়েছেন। বেকার হয়েছেন। বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন কোনোভাবে। একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, করোনাকালে দেশে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ, যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। এখন এই গরিব মানুষেরা জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর চাপ সহ্য করবে কীভাবে? ব্যয় বাড়বে অথচ আয় বাড়ার তো কোনো উপায় বা ব্যবস্থা নেই। যাদের আছে তাদের জন্য সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যাদের নেই তাদের কী হবে?

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হিসাব অনুযায়ী ডিজেলের দাম বাড়ায় এবার বোরো মৌসুমে সেচ বাবদ কৃষকদের বাড়তি খরচ হবে ৭৫৭ কোটি টাকার মতো। কারণ দেশের ৭০ শতাংশ জমির চাষ ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রনির্ভর। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিুসাবে বিঘাপ্রতি সেচের জন্য বাড়তি খরচ জুগিয়ে ধান বিক্রিতে ৩ শতাংশ মুনাফা কমবে কৃষকদের। এর ফলে সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।

ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর আগে যদি এর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করা হতো তাহলে সরকার হয়তো এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তটিন না-ও নিতে পারতো। কিন্তু একবার দাম বাড়িয়ে আবার কমানোর অতীত কোনো নজির না পাওয়ায় এটা মনে হচ্ছে তেলের দাম আর কমবে না। কয়েকদিন এ নিয়ে কিছুটা উত্তাপ-উত্তেজনা থাকবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের দেশের মানুষের ধৈর্য ক্ষমতা অসাধারণ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলেও বেঁচে থাকার ইচ্ছা আঁকড়ে থাকে। তবে মানুষের জীবন নিয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করাই ভালো।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

সান নিউজ/এফএইচপি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক : আমাদের কাছে সব প্রার্থী সমান। দল বা প্রার...

৬ অঞ্চলে ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ৬ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ৬০ কি.মি বেগে ঝড়ে...

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ শুক্রবার (৩ মে) বেশ কিছু খ...

২৫ জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কাল

নিজস্ব প্রতিবেদক : তীব্র তাপপ্রবাহে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য...

ভারতকে টপকে শীর্ষে অস্ট্রেলিয়া

স্পোর্টস ডেস্ক : ভারতকে সরিয়ে টেস্টে শীর্ষস্থান দখল করেছে অস...

৭ জেলায় ঝড়-বৃষ্টির আভাস

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ দেশের ৭ জেলার ওপর দিয়ে ঝড়-বৃষ্টির পূর্ব...

বনানীতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: কারখানা বন্ধের...

নিজ্জর হত্যায় সন্দেহভাজন ৩ জন গ্রেফতার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কানাডার নাগরিক...

মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৬ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্...

শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল ফিলিপাইন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিপাইনে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। শুক্র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা