ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন (ছবি: প্রতীকী)
মতামত

ইউক্রেন সংকটে দক্ষিণ এশিয়ায় যে প্রভাব পড়তে পারে 

ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল:

রোগ না হলেও কোষ্ঠকাঠিন্য নামক শারীরিক অস্বস্তি যে রোগের সূচনা করতে পারে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। সম্প্রতি রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের ঘটনা তেমনই কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে কোষ্ঠবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক সরকারের, অন্তত ভারত ও পাকিস্তানের জন্য।

আগে ভারতের কথা বলি। একাধারে মস্কো ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছে নয়াদিল্লি। তারা এমন কোনো মন্তব্য করছে না, যাতে করে ওয়াশিংটন ক্ষুব্ধ হয়। আবার তাদের তেমন কোনো বক্তব্য নেই রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। স্পষ্টতই ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের ঘটনায় ভারতের ভূমিকা আর রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট চলাকালে আজকের ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান প্রায় অভিন্ন।

এখন পর্যন্ত ভারতীয় কূটনীতিকরা ইউক্রেন সংকট আবর্তন করে জনসমক্ষে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে রাশিয়া সন্তুষ্ট। জাতিসংঘে নয়াদিল্লির রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে রাশিয়া গৃহীত সামরিক কৌশল নিয়ে সমালোচনা থেকে বিরত রয়েছেন। বিবদমান সব পক্ষের প্রতি তার উপদেশ হচ্ছে-সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করুন। গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চাপ দেননি; মোদি বলেছেন, সংলাপ করুন, যুদ্ধবিরতিতে যান।

ভারতের এই কৌশল কতটা উপকারী, বোঝা ভার। কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ কয়েকটি বৃহৎ ভারতীয় স্বার্থক্ষয়ী। প্রথমত, ইউক্রেনে পুতিনের অভিযান যত গভীর হবে, রাশিয়া ততই চীনের তলায় হারিয়ে যেতে থাকবে এবং সেক্ষেত্রে রাশিয়ার কাছে গুরুত্ব কমবে ভারতের। দ্বিতীয়ত, ওয়াশিংটনকে যত বেশি ইউক্রেনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা শক্তির ভারসাম্য তত দীর্ঘায়িত হবে। এর কোনোটিই ভারতের জন্য ভালো নয়।

আরও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে। এখন রুশ প্রশ্নে ভারতের নীরবতা বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র এটিকে ইতিবাচকভাবেও নিতে পারে; আবার নেতিবাচকভাবেও। গত বছর রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনে নয়াদিল্লি। ওয়াশিংটন অসন্তুষ্ট চিত্তে সেটির অনুমোদন দিলেও ইউক্রেনের ঘটনার পর রাশিয়ার সঙ্গে পরবর্তী প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসন বাদ সাধবে বলে মনে হয়।

আরেকটি বিষয় হলো অস্ট্রেলিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপ, যা কোয়াড নামে পরিচিত। ভারত বাদে কোয়াডের বাকি তিন দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এরই মধ্যে। এ অবস্থায় রাশিয়ার ব্যাপারে ভারতের নীরবতা ইউরোপের ওইসব দেশকে ক্ষুব্ধ করতে পারে, যারা কেবল চীনা পণ্য আমদানি করবে না বলেই হাত বাড়িয়েছিল ভারতের বাজারে।

ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নালে সম্প্রতি মানজারি চ্যাটার্জি মিলার লিখেছেন, ভারতের উচিত বুঝিয়ে শুনিয়ে রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে ফিরিয়ে আনা। তবে আমার মনে হয় না, দিল্লি তার পুরোনো রাশিয়া নীতি বদলাবে। যদি বদলাতো, তাহলে ২০২০ সালেই রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘর্ষের পর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় চীনের ওপর চড়াও হতো নয়াদিল্লি। অথচ সে সময় দিল্লি বেইজিংয়ের ওপর কার্যকর কোনো চাপই দেয়নি শুধু মস্কোর মুখের দিকে চেয়ে। ফলে ইউক্রেনের ব্যাপারে পুতিন যদি আপসহীন মনোভাব ধরে রাখেন, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না তাকে বোঝাতে সক্ষম হবেন মোদি। নিঃসন্দেহে ইউক্রেন ইস্যু যত না হুমকি, তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভারতের জন্য।

ইউক্রেন ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থা ভারতের মতো গুরুতর না হলেও তাৎক্ষণিক। মূলত ইউক্রেন ইস্যুর কারণেই পূর্বনির্ধারিত রাশিয়া সফর দ্রুত শেষ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। খেয়াল করার মতো বিষয় হলো, গত কয়েক বছরে প্রধানত ভূ-রাজনৈতিক কারণে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বেড়েছে পাকিস্তানের। পাকিস্তানের পুরোনো মিত্র চীন। গত কয়েক বছর টানাপোড়েন গেছে ইন্দো-রুশ সম্পর্কে। সেই সুযোগে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ে চীনের এবং তার মাধ্যমে পাকিস্তানের।

ইমরান মস্কো গিয়েছিলেন নিছক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার স্বার্থে। কিন্তু ইমরানও মস্কোয় নামলেন আর রুশ সৈন্যরাও সীমান্ত পার হলো, ঘটনাটা অনেক নিন্দুকের মনে সন্দেহ জাগাতে পারে। অবশ্য কুটনীতিতে ভারতের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তান। কিয়েভে অবস্থানরত তাদের দূত প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ইউক্রেনের রাষ্ট্রগত অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে ইসলামাবাদ। তবে পাকিস্তানের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে রাশিয়াকে খুশি রেখে ইউক্রেনের সঙ্গে (সম্প্রতি সম্পাদিত) প্রতিরক্ষা মৈত্রীতে ভারসাম্য আনা। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই দুর্বল। এদিকে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার কারণে পাকিস্তান চীনের মাধ্যমে রাশিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছে। তবে ইসলামাবাদের সতর্ক থাকা দরকার, বিশ্বমঞ্চ ও ইউরোপের বাজারে পাকিস্তানের বৃহত্তর বাণিজ্যিক স্বার্থকে খর্ব করবে তার অধিক মস্কোঘেঁষা নীতি।

আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে মূল বিপদ হচ্ছে, সম্প্রতি দেশটিতে সৃষ্ট অমানবিক পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য দাতা গোষ্ঠীর চিত্ত বিক্ষেপ ঘটাবে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট। এরই মধ্যে আফগানিস্তানে সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের সাহায্যের জোগান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে জাতিসংঘ। এখন চলমান ইউক্রেন সংকট দীর্ঘায়িত হলে বছরটা ভালো যাবে না আফগান অর্থনীতির জন্য। সুতরাং নিজেদের প্রতি মনোযোগ বাড়াতেও তালেবানরা চায় দ্রুত ইউক্রেন সংকটের অবসান।

আরও পড়ুন: পশ্চিমা বিশ্বের উস্কানি ও ভ্রান্ত নীতির পরিণতি

এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোয় রাশিয়ার বাণিজ্য উপস্থিতি তেমন বৃহৎ নয়। নেপাল ও বাংলাদেশের শক্তি খাতে রাশিয়ার কিছু বিনিয়োগ আছে; আর আছে শ্রীলংকার চা উৎপাদনে। তবে মজার বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে ইউক্রেন সংকট। নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হলে অবশ্যই নতুন বাজার খোঁজায় ঝুঁকবে রাশিয়া। সেক্ষেত্রে যেহেতু এ অঞ্চলে চীনের বর্ধিত বিনিয়োগ রয়েছে, সেহেতু চীনা বিনিয়োগের ছদ্মাবরণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাজার বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে পারেন পুতিন। সেক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন-তারা কি পুরোনো পশ্চিমা বাজারেই আবদ্ধ থাকবেন, নাকি ছুটবেন রুশ বিনিয়োগের পেছনে।

মাইকেল কুগেলম্যান : ওয়াশিংটনভিত্তিক এশিয়া প্রোগ্রামের উপপরিচালক।
ফরেন পলিসি থেকে ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল।

সাননিউজ/এমএসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

বোয়ালমারীতে স্বর্ণের কারিগরকে কুপিয়ে জখম

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে...

বজ্রপাতের সময় করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক: চলমান তাপপ্রবাহ...

নিজ্জর হত্যায় সন্দেহভাজন ৩ জন গ্রেফতার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কানাডায় বসবাসর...

ইন্দোনেশিয়ায় বন্যা-ভূমিধস, নিহত ১৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইন্দোনেশিয়ার ম...

ভালুকায় পানি ও স্যালাইন বিতরণ

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রচন্ড...

যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটে 

নিজস্ব প্রতিবেদক: আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের...

বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ি জেলার র...

ভারতে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শিখদের ধর্মীয় গ্রন্থ ‘গুরু গ্রন্থ স...

রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত ১ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় মোটরসাইকেলের নি...

চলন্ত ট্রাকে চালকের মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি: চট্টগ্রাম জেলায় সীতাকুণ্ডে একটি চলন্ত ট্রাকে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা