ফিচার

প্লাষ্টিকের দখলে আদিবাসীদের কুটির শিল্প

স্বপন মির্জা, সিরাজগঞ্জ

দেশ জুড়ে প্লাষ্টিক সামগ্রীর আধিপত্য। ব্যবসাও বেশ। বাহারী প্লাষ্টিক সামগ্রী পৌঁছে গেছে তৃনমুলে। বাদ যায়নি গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার্য্য কুলা, চালুন, দাঁড়িপাল্লা, ধামা, কাঠা, টুকরি, টোপা সহ নানা জিনিসপত্র। আর এ সকল প্লাষ্টিক জিনিস পত্রের কারণে বাঁশ ও বেতের তৈরী গৃহস্থালি জিনিসপত্র এখন অতীত হতে চলেছে।

মানুষ প্লাষ্টিকের সস্তা জিনিসের পরিবর্তে বেশি মুল্য দিয়ে আর এসব কিনতে চায়না। তাই চলনবিলের আদিবাসী পল্লীর বাঁশ, বেতের কারিগড়দের আগের সেই সুদিন নেই। অনেক পরিবার কুটির শিল্পের কাজ ছেড়ে বাধ্য হয়েছে অন্য পেশা বেছে নিতে। এ কারণে ঐতিহ্যবাহী আদিবাসীদের তৈরী কুটির শিল্প সামগ্রী এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। যারাও আছে তারা শুধুই পুর্ব পুরুষের পেশাকে কোন রকমে টিকিয়ে রাখছে।

জানা গেছে, উত্তরের সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার দেশীগ্রাম, মাধাইনগর, তালোম, বারুহাঁস, তাড়াশ সদর, মাগুরা বিনোদ, দিঘী সগুনা, নওগাঁ এবং রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া, ধামাইনগর ও ধুবিল ইউনিয়নে প্রায় ৬০/৭০ হাজারের মত বিভিন্ন জনগোষ্ঠির আদিবাসীর বসবাস। এদের মধ্যে উড়াঁও, মাহাতো, তেলী, তুড়ি, রবিদাস, কনকদাস, সাঁওতাল, বড়াইক, সিং, সরকার সহ একাধিক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী বংশ পরম্পরায় তাদের হাতে তৈরী বাঁশ-বেতের কুটির শিল্প সামগ্রী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

তারা খেজুর গাছের পাতা দিয়ে তৈরী মাদুর, মাছ রাখার বাঁশের তৈরী খালৈই, মাছ শিকারের পলো, আর বর্ষকালে মাছ শিকারের উপকরণ হিসেবে বুচনা বা ধিয়াল, জাকৈই, চাউল উড়ানোর কাজের ব্যবহৃত বেতের তৈরী কুলা, ধান চালনা (চালুন), খৈ চালনা (খৈচালা), বাড়িতে কোন অতিথি আসলে বসতে দেওয়ার জন্য বাঁশের তৈরী বসার মোড়া, হাঁস মুরগীকে লালন পালনের কাজের ব্যবহার করা বাঁশ দিয়ে তৈরী টপা, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বাঁশ ও পাটের দড়ি দিয়ে তৈরী খাটিয়া বা খাটলি, মাটি আনা নেওয়ার জন্য বাঁশের তৈরী টুপরি, ধান, চাল সহ বিভিন্ন ফসলাদি পরিমাপের জন্য বেঁতের তৈরী দাড়িপাল্লা, ঢাকী, মুড়ি-মুড়কি খাওয়ার জন্য বেতের তৈরী কাঠা, ধানের বীজ বোপনের জন্য বেত দিয়ে তৈরী ধামা, ঘড়-বাড়ি পরিস্কার পরিচছন্ন রাখতে ব্যবহার করা হত বিন্নার ফুলকা দিয়ে তৈরী ঝাঁড়– বা সাফটা, গরুর মুখে দেওয়ার জন্য বাঁশের তৈরী টোনা। এছাড়াও আদিবাসীদের বিয়েতে অপরিহার্য বাঁশের তৈরী পেটারী ইত্যাদি তৈরী করে থাকেন।

অতীতে এসব জিসিন পত্র জেলার মানুষের প্রতিটি পরিবারে থাকলেও এখন সহজলভ্য অন্যান্য জিনিসের কারনে তা অনেকটাই ভাটা পড়েছে। কৃষি জমি আবাদের পাশাপাশি বছরের যে ৬ মাস তারা বসে থাকতো সে সময়টি গৃহস্থালির ঐসব অপরীহার্য জিনিসপত্র তৈরী করতো। সে সময় স্থানীয় অর্থনীতিতে বেশ ভুমিকা রাখতো তা। এলাকার হাটে-বাজারে ব্যাপক চাহিদা নিয়েই তা বিক্রি হতো। বাঁশ-বেতের জিনিস পত্রের হাটে থাকতো আলাদা পট্টি। তবে এখন সেই চাহিদা অতীতের মত নেই। প্লাষ্টিকের সুলভ পন্যের কাছে অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে।

এক সময়ে চলনবিল অধূষ্যিত আদিবাসী পল্লী গুলোতেও আষাঢ় মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত শ্রমজীবি আদিবাসীরা বিশেষ করে যে সকল নারী-পুরুষ কৃষি শ্রমিক, ইট ভাটা, ফসলী মাঠে কাজ করেন সেই সকল পরিবারগুলোতে অভাব অনটন নিত্য সঙ্গী ছিল। তা ৭০ পরবর্তী ৮০- ৯০ দশক পর্যন্ত অনেক আদিবাসী শ্রমজীবি পরিবারকে বেশ ভুগিয়েছে। তবে বছরের প্রায় চার মাস আদিবাসীদের জীবন জীবিকায় তাদের তৈরী কুটির শিল্প সামগ্রী বাজার জাত করার মধ্য দিয়ে অন্যতম ভুমিকা রেখেছে। তখন চলনবিল অঞ্চল্যের মানুষের গৃহস্থালি কাজ কর্মে আদিবাসীদের তৈরী কুটির শিল্পের তৈরী জিনিসপত্র অপরিহার্য ছিল। হাট বাজারে প্রয়োজনের তাগিদেই কৃষিজীবি পরিবার গুলো আদিবাসীদের তৈরী নানা কুটির শিল্প সামগ্রী স্বাছন্দে ব্যবহার করতেন বছরের পর বছর। যা টেকশই ও পরিবেশ বান্ধবও ছিল।

তাড়াশ, রায়গঞ্জের আদিবাসীরা অধিকাংশ সনাতন ধর্মালম্বী। উত্তরাঞ্চলের খাদ্য ভান্ডার খ্যাত এ দুটি এলাকায় কৃষি ও কুটির শিল্প খাতে তাদের অবদান স্মরনীয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বেশ কর্মঠ। দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠে বেশ গতর খাটিয়েই কাজ করে সৎবান আদিবাসী নারীরা। ধান, পাট, ভুট্টা, সরিষার প্রতিবার বাম্পার ফলনে এই আদিবাসীরাই এই অঞ্চলে অন্যতম ভুমিকা রাখেন। তবে সে তুলনায় এই অভাবী, অসহায় মানুষ গুলো খুব একটা মুল্যায়িত হয়না। ভুমি জটিলতাই তাদের প্রধান সমস্যা। এছাড়া পাহাড়ী আদিবাসীদের সরকার যেভাবে সহযোগীতা করে থাকে সে তুলনায় উত্তরাঞ্চলের এই আদিবাসীরা সুবিধা পায়না। হয় নানা ভাবে বঞ্চনার শিকার।

তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর গ্রামের ৭৫ বছরের হৈমন্ত্রী উড়াঁও বলেন, কালের পরিক্রমায় সভ্যতার বিকাশে পাড়া-গাঁয়ে শুধু নয় সর্বত্রই প্লাষ্টিক সামগ্রীর ব্যবহারের ফলে চলনবিলের আদিবাসীদের বাঁশ, বেতের তৈরী প্রসিদ্ধ কুটির শিল্প সামগ্রী বিলুপ্তির খাতায় নাম লেখাতে চলেছে। তবে সে ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারী পৃষ্ট-পোশকতার অভাব রয়েছে।

এছাড়া রায়গঞ্জের গোপালপুর গ্রামের মোহন কনক দাস বলেন, বছরে যে চার মাস আমার বাবা মৃত পলান কনক দাসের কাজ থাকতো সেসময় বাঁশ বেতের কুটির শিল্প সামগ্রী তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তার বাবার সেই ব্যবসা রপ্ত করে এখন তিনি সংসার চালান। স্ত্রী বিনোদিনী কে নিয়ে দিনভর বাঁশ বেতের তৈরী কুটির শিল্প সামগ্রী বিক্রি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি একমাত্র ছেলে মনোরঞ্জনকে ইংরেজী সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী করিয়েছেন। তবে ওই গ্রামের মোহন কনক দাস তার বিধবা বোন ললিতা কনক দাস ব্যতিত কেউ আর এই কুটির শিল্পের কাজ করেন না। এখন আর খুব একটা চাহিদা নেই বলে তা আমরা বাদ দিতে বসেছি। তিনি আরো জানান, মানুষ বন জঙ্গল কেটে ফেলার কারণে বেত প্রায় দুস্প্রাপ্য হয়ে যাওয়ায় অনেক কিছুই আর তৈরী করাও যাচ্ছেনা।

এদিকে ৮০’র দশকে যে সকল আদিবাসী পরিবার কাজ না থাকার সময়ে শ্রম বিক্রি করতে না পেরে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে কুটির শিল্পের প্রতি নজর দিতেন সে অবলম্বনও হাত ছাড়া হয়ে গেছে বর্তমান সময়ে। একাধিক কুটির শিল্পের বেকার কারিগর বলেন, এখন বাঁশ, বেতের তৈরী কুটির শিল্পের সাথে জড়িত আদিবাসী পল্লীর সে সময়কার অনেক পরিবার কুটির শিল্পের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ হিসেবে তারা বলেন, তাদের তৈরী ওই সকল কুটির শিল্পের সামগ্রী এখন আর মানুষজন তাদের গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করতে চায় না। ফলে ওই সকল কারিগর বেকার হয়ে হাত গুটিয়ে অন্য পেশার কাজের জন্য অনেকেই শহরে দিকে ছুটে চলছেন বা অন্য কোন পেশায় কাজ করছেন।

এ অঞ্চলের আধিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে উড়াঁও ফাউন্ডেশন। তারা আদিবাসীদের আদি ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি তাদের নানা ভাবে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে আসছে। সংগঠনের সাধারন সম্পাদক অধ্যাপক যোগেন্দ্র নাথ সরকার জানান, বাঁশের দামও বেশ চড়া, মাছ শিকারের বাঁশের তৈরী উপকরণ আর চলেনা। কারণ কারেন্ট জাল, নেট জাল, সুতি জাল দখল করে নিয়েছে বাজার। আবার এক সময়ে মাটি কাটার টুকড়ি ব্যবহার হতো প্রচুর কিন্তু মাথায় করে টুকড়িতে মাটি নিয়ে বহন করার দিন শেষ। কারণ মাটি কাটার যন্ত্র এক্সেভেটর সব চাহিদা পুরণ করছে। আর আগের মত গরুর পাল না থাকায় তাদের মুখে বাঁশের তৈরী টোনাও পড়াতে হয়না। এ কারনেই আদিবাসীদের কুটির শিল্প অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। সরকারী পৃষ্টপোষকতা আর নতুন বাজার তৈরীতে ভুমিকা রাখা না গেলে এ পেশা আর বেশি দিন স্থায়ী হবেনা।

সিরাজগঞ্জ জেলা আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সুশীল মহান্ত জানান, চলনবিলের উড়াও, মাহাতো সহ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর লোকজন এক সময় কুটির শিল্প সামগ্রী তৈরী করতেন । সভ্যতার অগ্রগতিতে বর্তমানে সে সকল পণ্যের চাহিদা না থাকায় নানা কারণে কুটির শিল্পে তাদের আগ্রহ আর নেই। ফলে দুঃসময়ের হাতের কাজটি এখন আর আদিবাসী ওই সকল পরিবারের জীবিকা নির্বাহে কাজ দেয়না।

এ প্রসঙ্গে তাড়াশ ইউএনওর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার মো. ওবায়েদুল্লাহ জানান, কুটির শিল্পের জন্য সরকারের নানামুখী পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। চলনবিল একটি বৃহৎ এলাকা, এলাকার আদিবাসীদের কুটির শিল্প রক্ষায় সমন্বিত উদ্দ্যোগ প্রয়োজন।

সান নিউজ/সালি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

দিবাকরকাঠী মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

ঝালকাঠি সদর উপজেলার নথুল্লাবাদ ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিবাকরকা...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন সিপিবি প্রার্থী শ. ম. কামাল হোসেন

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মুন্সীগঞ্জ-৩ (সদর-গজারিয়া) আসনে মনোনয়নপ...

ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত

উৎসবমুখর পরিবেশে ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন (২০২৬–২০২৭...

মুন্সীগঞ্জে ভোটের গাড়ি ‘সুপার ক্যারাভান’

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বিষয়ে জনসচেতনতা...

সিরাজদীখানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৮টি দোকান পুড়ে ছাই

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে বড় বাজারের কাঠপট্টি এলাকায় মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড...

নোয়াখালীতে ৬ আসনে ৬২ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে আনন্দমুখর পরিবেশে নোয়াখালীর ৬টি স...

মুন্সীগঞ্জে আপন দুই ভাইসহ ৩ জনকে কুপিয়ে জখম

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় পূর্ব বিরোধের জের ধরে আপন দুই ভাইসহ ৩ জনকে কুপিয়ে জখম...

ঝালকাঠিতে ২৫ জনের মনোনয়নপত্র দাখিল

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঝালকাঠিতে ২৫ জন প্রার্থী মনোন...

এনসিপিতে যোগ দিয়ে মুখপাত্র হলেন আসিফ

জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছেন সাবেক উপদেষ্টা আসিফ...

জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠনের সক্ষমতা আছে: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

ঢাকা-৮ আসনে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ১১-দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী ও জাতী...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা