অঘোরী সাধু
ফিচার

শবদেহে মিলিত হন অঘোরী সাধু 

আহমেদ রাজু

অঘোরী সাধু। তাদের জীবন খুব রহস্যময়। তারা সাধনা করেন শবদেহের ওপর৷ মানুষের মাথার খুলিতে তারা খায়। লোকালয়ের আশপাশে তাদের দেখা মেলে না৷ অঘোরীরা কালী সাধক৷ শবদেহের সঙ্গে তারা সঙ্গম করেন।

অঘোরীদের সাধনপথ তান্ত্রিক। কাপালিকদের মতোই৷ তাদের কাছে পৃথিবীর কোনও কিছুই অপবিত্র নয়৷ এই অঘোরীরা যে জীবনযাপন করে, সেটি হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে খুব ‘অপবিত্র’৷

কিন্তু সেটি তারা করে থাকেন খুব সচেতনভাবেই৷ বস্তুজগতের কোনও কিছুর প্রতিই তাদের মায়া বা মোহ নেই৷ নিজেদের মলমূত্র তারা যেমন খেতে পারেন, তেমনই পারেন শবদেহের মাংস খেতে।

বেনারসের গঙ্গার ধারেই ছিলো এক অঘোরীর আস্তানা। আস্তানাটি তৈরি হয়েছিলো মূলত কয়েকটি কাপড় দিয়ে, যে কাপড়গুলো শবদেহ ঢাকতে ব্যবহার করা হয়৷ আর সেই আস্তানার বাইরেই গঙ্গাপাড়ের কাছে ভাসছিলো এক গলিত শবদেহ৷ দেহটি ছিলো একটি ভেলায় ভাসানো৷

ভেলার পাশেই এক নৌকার মাঝি বলেছিলেন, শবদেহটি সম্ভবত ওই অঘোরী সাধু ভক্ষণ করেননি, কেন না সেটি সাপে কাটা৷ তবে ভেলার পাশে একটি পাত্রে থকথকে, অনেকটা ডিমের কুসুমের মতো একটা পদার্থ ছিলো। সেটি সম্ভবত এই শবদেহটিরই মস্তিষ্কের অংশ, হয়তো সেই অঘোরী তা ভক্ষণ করেছিলেন। অঘোরী সাধুদের জীবন নিয়ে এক গবেষণামূলক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য!

ভালো মন্দ-সব কিছুতেই তারা ঈশ্বর দেখতে পান৷ অঘোরীরা আসলে শৈব৷ যার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেন কালী৷ কালীই শক্তির উত্‍স৷ হিন্দুদের কাছে মা কালী থেকে উত্‍সারিত এই শক্তি থেকেই বিশ্বের সব কিছুরই উত্‍পত্তি৷ আর শক্তির মধ্যে তো একযোগে মিলে থাকে ভালো আর মন্দ৷ মা কালী যেমন একাধারে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের দেবী৷ এই শক্তিও তাই৷ একইসঙ্গে লালন আর বিনাশ। সদয় আর নির্মম৷ জীবন আর মৃত্যু-সবই তিনি৷

বিশ্বাস, রহস্যময় এই অঘোরী সন্তরা তাই অন্তরের শিবশক্তি জাগাতে কালীরই সাধনা করেন, তবে তাদের আরাধ্যা হলো শ্মশান কালী৷ এই কালীর বাম পা শিবের বুকে স্থাপিত৷ যেটা এক অর্থে মোক্ষলাভের বিকল্প পথের রূপক৷ এই বিকল্পপথ বড়ই কঠিন। অদ্ভূত, ভয়ঙ্কর। নির্মম কৃচ্ছসাধনের৷ কঠিন হলেও অঘোরীরা নির্বাণের জন্য এই পথটিই বেছে নেন। প্রতিটি অঘোরীই তার সাধনক্রিয়ার জন্য বেছে নেন গভীর রাত৷ অন্ধকার যখন চরাচর ঢেকে দেয়, প্রতিটি প্রাণি চলে যায় ঘুমের দেশে, তখন শুরু হয় তাদের সাধনা৷ এদের সাধনপীঠ হলো শবদেহ৷ যার ওপর বসেই এদের ধ্যান শুরু হয়৷ সামনের জ্বলন্ত চিতা আর উড়তে থাকা ছাই প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয় শেষ পর্যন্ত কোন গন্তব্যে পৌঁছতে চলেছে৷

এই রহস্যময় অঘোরীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অদম্য কৌতূহলের কারণে অনেক গবেষক ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তবে, প্রকৃত অঘোরীর সঙ্গে দেখা করাটা মুখের কথা নয়৷ এরা জিপসির মতো এক শ্মশান থেকে অন্য শ্মশানে ঘুরে বেড়ান৷ সুতরাং তাদের কোনও পাকা ঠিকানা নেই৷ অঘোরীদের ক্রিয়াকর্মের জন্য অত্যন্ত গোপনীয়তা দরকার। তাই মানুষের আনাগোনা যেখানে খুবই কম, এমন কোনও শ্মশানে তাদের পাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি৷

আগাম পরিকল্পনা করে কোনও অঘোরীর সঙ্গে দেখা করা যায় না। খুঁজে বেড়ালে হয়তো তেমন কারও সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে যেতে পারে৷ অনেকেই জানতে চান, দেখা হওয়ার পর অঘোরীরা ঠিক কী বলে থাকেন? তাঁরা সত্যিই দেহাবশেষ ভক্ষণ করেন কি না? বা রতিক্রিয়া করার জন্য তাঁরা ঠিক কী ধরণের শবদেহ পছন্দ করেন? কিন্তু অঘোরীরা এতই কম কথা বলেন (অনেক সময় আদৌ কথা বলেন না) যে সব কিছুর উত্তর জানা সম্ভব নয়৷ অঘোরীরা কথাবার্তায় অত্যন্ত অনিচ্ছুক আর শান্ত স্বভাবের মানুষ৷ তাদের ক্রিয়াকর্ম সমস্তটাই হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে, এবং তারা সচেতনভাবে এই প্রসঙ্গে কথাবার্তা এড়িয়ে চলেন৷ এমন কোনও অঘোরী খুঁজে পাওয়া যায়নি যিনি সাগ্রহে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন৷

গবেষকরা জানার চেষ্টা করেছেন অঘোরীদের এই বিপুল মদপান আর সর্বক্ষণ গাঁজা সেবনের কেন দরকার পড়ে? উত্তর মেলেনি৷ তবে তাদের ভক্তদের বক্তব্য, নেশার ঘোরে থাকলে হয়তো ধ্যানের সময় মনঃসংযোগ ভালো হয়৷ আর ‘ক্রিয়া’র সময় মনের ভিতর হয়তো ভয় জন্মাতে পারে, নেশা সম্ভবত সেটা দূরে রাখতেও সাহায্য করে৷ প্রকৃত অঘোরীর একটা বড় লক্ষণ হলো তার বাকসংযম৷ এরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিরুত্তাপ থাকেন, আর এদের চাউনিতেও থাকে একটা শূন্যতা৷ তবে এর একটা কারণ হতে পারে এরা সবসময় নেশাগ্রস্ত থাকেন প্রচুর মদপান এবং গাঁজা সেবন করেন।

কোনও অঘোরীকে এই প্রশ্নটা করলে জবাব আসবে, জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিস্বাদের স্বাদ নেওয়া, প্রাণহীনতাকেই উপভোগ করা৷ বস্তুত, অঘোরীরা স্বাদের জন্য খাদ্য গ্রহণ করেন না, বা সুখের জন্য রতিক্রিয়া করেন না৷ আর সেই কারণেই যে-কোনও ধরনের খাবার, হতে পারে সেটা নিজের দেহের বা অন্য কারও বর্জ্য, তারা ভক্ষণ করতে পারেন৷ এখানে খাবার উদ্দেশ্য একটাই, জীবনধারন৷ স্বাদ নেওয়া নয়৷

অঘোরী সাধুরা দল বেঁধে ঘোরেন৷ তবে দল বেঁধে ঘুরলেও তাঁরা কখনওই দল বেঁধে থাকেন না৷ এই সাধুদের একমাত্র অগ্রাধিকার একাকিত্ব আর নির্জনতা৷ শ্মশানঘাটগুলোয় ঘুরতে থাকা কুকুরের দল এদের একমাত্র সঙ্গী বলা যেতে পারে৷ অঘোরীরা খাদ্য এবং পানীয় গ্রহণ করেন মড়া মানুষের খুলিতে৷ নরকোটির উপরের অংশটিই খাদ্য আর পানীয়ের আধার হিসেবে ব্যবহার করেন।

মোক্ষলাভের পর কোনও অঘোরী সাধনার এই কঠিন পথ ত্যাগ করতেই পারেন৷ তবে ‘ক্রিয়া’ ছাড়লেও ত্যাগের পথ তিনি ছেড়ে দেন না৷ তিনি তখন গুরু হিসেবে অন্য অঘোরীদের পদপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন৷ মোক্ষ বা সিদ্ধিলাভ করেছেন, এমন এক অঘোরী সন্তের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এক গবেষক। তিনি ১৬ বছর সাধনার পর মোক্ষলাভ করেছিলেন৷ আর এই দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি কাটিয়েছিলেন গঙ্গাবক্ষে একটি নৌকার উপর৷ ১৬ বছরের মধ্যে তিনি একটিবারও নাকি নৌকার বাইরে যাননি৷ মোক্ষলাভের পথটি অবশ্য তার কাছে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই৷ কেননা, সেটি আড়ালেই থাকে৷ তিনি শুধু বলেছিলেন কীভাবে তিনি দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে জীবনধারণ করেছিলেন৷ একটি আশ্রমে যখন তার দেখা মেলে, তাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন তিনি। তার সাধারণ-সাফসুতরো চেহারা, পরিচ্ছন্ন পোশাক তাকে আশ্চর্য করে দিয়েছিলো। একটু পর গবেষক বুঝলেন ফারাকটা চিন্তাভাবনা আর মানসিকতায়৷ সেই সাধু কথাবার্তায় একেবারেই অনাগ্রহী৷ আশ্রমে কোথায় একান্তে সময় কাটানো যাবে, সারাক্ষণ সেটারই সন্ধানে রয়েছেন৷ সেইসঙ্গে সর্বক্ষণ তিনি যেন নিজের চিন্তায় নিমজ্জিত৷ বুঝলেন, তিনি প্রকৃতই একজন অঘোরী৷

অঘোরীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন মেশার পরও সংশ্লিষ্ট গবেষক কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পাননি। কেন অঘোরীরা এমন একটি জীবনযাপন করেন? এই জীবনযাপনের লক্ষ্যটাই বা কী? সিদ্ধিলাভের উপকারিতাটাই বা কী? কীভাবে এক অঘোরী বুঝতে পারেন তিনি মোক্ষলাভ করেছেন? অঘোরী বা তান্ত্রিকরা শক্তিরই সাধনা করে থাকেন৷ এই শক্তির স্বরূপটা কী? এই শক্তি কি অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে? না যাবতীয় সম্ভাবনাকে নয়ছয় করে দেয়? কে জানে৷ নিজের ইচ্ছেপূরণের জন্য কোনও-কোনও সাধক হয়তো নিজের অর্জিত শক্তির অপব্যবহার করতে পারেন৷ কিন্তু প্রকৃত অঘোরীর মন সব ভয়, কামনা, লালসা, ইচ্ছেকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দিতে সক্ষম৷ এইরকম মানসিক অবস্থায় এক অঘোরী কালীরই অংশ হয়ে উঠেন৷ মোক্ষলাভের পর সব কিছুই তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়৷ থাকে শুধু ‘উপলব্ধি’৷

সান নিউজ/ আরএস

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

আজ বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ...

কাতারের সঙ্গে ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই 

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ও কাতা...

চরাঞ্চলে তরমুজের বাম্পার ফলন

গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধার চ...

দেশবিরোধী অপশক্তি ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশবিরোধী একটি...

কাতারের আমির-প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: কাতারের আমির শে...

অসুস্থ হয়ে হাজতির মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর কেরানী...

সালমানের বাড়িতে হামলা, দ্বিতীয় বন্দুক উদ্ধার

বিনোদন ডেস্ক: বলিউড সুপারস্টার সা...

কাহালুতে শিশুর মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়

জেলা প্রতিনিধি: বগুড়ার কাহালুতে ব...

ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত ১

বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়া জেলায় ট্রে...

ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক

জেলা প্রতিনিধি: কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের মাস্টার গোলাম র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা