নিজস্ব প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। জাতিসংঘ এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন শুরু করে ১৯৭৫ সাল থেকে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই নারী দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাফল্যের ক্ষেত্রে কাঙ্খিত অগ্রগতি যেমন আশাব্যঞ্জক, তেমনিভাবে বেশকিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু নিজেদের মধ্যেই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় সবাইকে পেছনে ফেলে সক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি জানান দিচ্ছে।
সোমবার ( ৮ মার্চ ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘ এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন শুরু করে ১৯৭৫ সাল থেকে। জার্মানির বামপন্থি পার্টির নেতা ক্লারা জেটকিন ১৯১০ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওম্যান কনফারেন্স’ বছরের একটি দিনকে সমাজে নারীর অবদানকে তুলে ধরার জন্য পালনের প্রস্তাব দেন।
১৯১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এরপর অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে দিবসটি পালিত হয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নারী দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়।
এর মধ্যে অন্যতম হলো বৈশ্বিক লিঙ্গ সক্ষমতা অথ্যাৎ লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো থেকে এমন কি ভারতের থেকেও উপরে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। ৫০ বছর আগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে আজকের যে বাংলাদেশের পথ চলা, অথচ লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে সেই পাকিস্তানের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় একবারে তলানীতে।
আর ভারত ৪টি সূচকের মধ্যে ৩টিতেই পেছনে পড়েছে বাংলাদেশের। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদনে ২০২০ এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে নারীর অগ্রগতি কতটা হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সামগ্রিকভাবে আগের চেয়ে অবস্থা বদলেছে। তবে এখানেই নারীর যাত্রা থেমে গেলে চলবে না বলে মনে করেন নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে নারীর অবস্থা আগের চেয়ে বদলেছে তা বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্যে ৪টি প্রধান সূচকে দেখলেই বোঝা যায়।
এগুলো হলো, নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৫০তম অবস্থানে রয়েছে। এই প্রতিবেদনে ১৫৩টি দেশের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতার চিত্র দেখা হয়েছে।
বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ৪টি সূচকের অধীনে ১৪টি উপসূচক রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি উপসূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে। এই ৪টি উপসূচক হলো, ছেলে ও মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়েদের সমতা, জন্মের সময় ছেলে ও মেয়েশিশুর সংখ্যাগত সমতা ও সরকার প্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী রয়েছেন।
তবে এখনও নারী-পুরুষের সমতার চিত্র খারাপ। অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ নারী পুরুষের সমতায় পিছিয়ে আছে। নারীদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ চাকরি পেতে, কর্মক্ষেত্রে ও রাজনীতিতে সম্মানজনক পদ পেতে এখনও বহু বেগ পেতে হয়। সেক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীর যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
ডব্লিউইএফ প্রতিবেদন অনুযায়ী, লিঙ্গবৈষম্য সূচকে বাংলাদেশ ৭২.৬০ পয়েন্ট পেয়ে বৈশ্বিক অবস্থান ৫০। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ১ নম্বরে। বাংলাদেশের পরেই ৬৮ পয়েন্ট নিয়ে নেপাল দক্ষিণ এশিয়াতে দুই ও বৈশ্বিক অবস্থানে ১০১ রয়েছে। ৬৮ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে শ্রীলঙ্কা ৩ নম্বরে অবস্থানে ও বৈশ্বিক অবস্থান ১০২ নম্বরে আছে।
এরপরেই দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতের অবস্থান ৪ নম্বরে আর ৬৮.৮ পয়েন্ট নিয়ে বৈশ্বিক অবস্থান আছে ১১২ নম্বরে। ৬৪.৬ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে ৫ নম্বরে আর বৈশ্বিক অবস্থানে ১২৩ নম্বরে আছে মালদ্বীপ। ভুটান ৬৩.৫ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে ৬ নম্বরে আর বৈশ্বিক অবস্থানে ১৩১ অবস্থানে। এ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে বা ৭ নম্বরে আছে পাকিস্তান। দেশটি ৫৬.৪ পয়েন্ট নিয়ে বৈশ্বিক অবস্থানে ১৫১ নম্বরে।
তিন সূচকে ভারত থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ : ডব্লিউইএফ বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদনে ২০২০ নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ৪টি প্রধান সূচকে প্রতিটি দেশের লৈঙ্গিক বৈষম্য দেখা হয়। এই ৪ সূচকের মধ্যে ৩টিতে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে ভালো করেছে। গতবারের তুলনায় ভারত এবার সামগ্রিক সূচকেও খারাপ করেছে। গতবারে তাদের বৈশ্বিক সূচকে অবস্থান ছিল ১১৮ নম্বরে, এবার তা বেড়ে ১২২ দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষায় অংশগ্রহণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে ১২০ নম্বর। এ সূচকে ভারতের অবস্থান ১১২। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ শীর্ষক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১। আর এ সূচকে ভারতের অবস্থান ১৪৯। শিক্ষায় অংশগ্রহণ সূচকের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ভর্তির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে অবশ্য বাংলাদেশ সারা দুনিয়ার মধ্যে এক নম্বরে।
নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ নম্বরে। এ সূচকে ভারতের বৈশ্বিক অবস্থান ১৮। স্বাস্থ্য ও আয়ু এই সূচকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে বাংলাদেশের অবস্থান ১১০। আর এ সূচকে ভারতের বৈশ্বিক অবস্থান ১৫০।
নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, সমাজে পুরুষ যে চোখে নারীকে দেখে তা পরিবর্তন না করলে নারী পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব না। বাংলাদেশে সবত্র এখনও প্রবল পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়। সবার আগে এটির অবসান ঘটাতে হবে। এর জন্য বাংলাদেশকে এখনও অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে বলে তাদের মত।
বাংলাদেশের নারীদের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম টেলিফোনে বলেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে আমরা এগিয়েছি অনেকটা এটা সত্য। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরিকরণে আমরা এখনও বহু পিছিয়ে আছি। নারী স্বাস্থ্যে বাংলাদেশ এগিয়েছে, শিক্ষায় এগিয়েছে। আবার দেখা যাচ্ছে বাল্যবিবাহের হার যদি বেড়ে যায়, তাহলে আমাদের নারীর সামগ্রিক পরিস্থিতি খারাপ হবে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণে বাংলাদেশকে এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সান নিউজ/এসএ
