চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শান্তিরহাট এলাকার দুগ্ধ খামারি মো. মঞ্জুরুল ইসলাম। তার খামারে প্রতিদিন ৪১০ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই কমতে থাকে তার দুধ বিক্রি।
তিনি জানান, ১৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার তার অবিক্রিত দুুধ থেকে গেছে ১৭০ লিটার। আজ শুক্রবারও প্রায় সমপরিমাণ দুধ রয়ে গেছে। এছাড়া বিক্রীত দুধও প্রতিলিটার ৬৫ টাকার স্থলে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়। এভাবে এক সপ্তাহে তার ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ টাকা।
একইভাবে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার নুরুল আমিন, বোয়ালখালী উপজেলার দিদারুল আলম, আনোয়ারা উপজেলার মামুনসহ অনেক দুগ্ধখামারি লকডাউনে লাখ টাকা ক্ষতির কথা জানান। এ সময় তাদের অনেকেই কেঁদে দেন।
খামারিরা বলেন, তাদের খামারে উৎপাদিত দুধের বড় গ্রাহক মিষ্টি উৎপাদনকারী বেকারী, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও দোকান। কিন্তু গত ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া প্রথম দফায় এক সপ্তাহের লকডাউনে দুধ বিক্রি কমতে শুরু করে। ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনে বন্ধ রয়েছে দুধ বিক্রি। তাই দুধ বিক্রী নিয়ে মহাচিন্তায় পড়েছেন দুগ্ধ খামারিরা।
চট্টগ্রাম জেলা ডেইরি ফার্মার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মালিক মোহাম্মদ ওমর বলেন, চট্টগ্রামে ৩৫০০ খামারে প্রতিদিন ১০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। লকডাউন শুরুর পর মিষ্টি কারখানার উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। ফলে খামারিরা তাদের খামারের দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। এমনকি অন্যত্র কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
চট্টগ্রামের মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফুলকলি ফুড প্রোডাক্টসের জেনারেল ম্যানেজার এম এ সবুর বলেন, স্বাভাবিক সময়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানে মিষ্টি উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন ২ থেকে আড়াই হাজার লিটার দুধের চাহিদা ছিল। লকডাউনের শুরুতে আমরা মিষ্টি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছি। তাই আপাতত আমরা দুধ সরবরাহ নেওয়া বন্ধ রেখেছি।
জমজম সুইটস এন্ড বেকস এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম এবং খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় আমাদের ২৩টি শো রুমে মিষ্টি এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য প্রতিদিন ১২০০ লিটার দুধ কেনা হত। গত ৩ দিন ধরে এই পরিমাণ নেমে এসেছে ৬০০ লিটারে। ১৪ এপ্রিল থেকে উৎপাদনই বন্ধ। ফলে এর পুরো প্রভাব পড়েছে দুগ্ধ খামারিদের উপর।
খামারিরা জানান, লকডাউনের পর দুধ বিক্রির পরিমাণ এবং দুধের দাম ৪০ ভাগ কমে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রামের খামারিরা। যানবাহনের অভাবে তারা শহরে দুধ সরবরাহ করতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে ২০-৩০ টাকায়ও দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। খামারিরা দুধ বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই দুধ দিয়ে ঘি তৈরী করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাজারে ঘিয়ের চাহিদা না বাড়ায় উল্টো বিপাকে পড়তে হয়েছে তাদের।
ডেইরি ফার্ম উদ্যোক্তাদের মতে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ রাখার সুযোগ থাকলেও এই সেক্টরে সেই সুযোগ নেই। একদিকে দুধ বিক্রি বন্ধ, অন্যদিকে পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে উভয় দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ডেইরি শিল্পোদ্যোক্তারা।
উদ্যোক্তাদের অনেকেই বলেন, গত বছর করোনার শুরুতে আমরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের প্রণোদনা পায়নি খামারিরা। পশুখাদ্যের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। এমন পরিস্থিতিতে খামারিরা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, গত লকডাউনে মিষ্টির দোকান চালু রাখা সম্ভব হয়েছিল। ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এবারের লকডাউনে মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় অন্য সেক্টরগুলোর মতো ডেইরি সেক্টরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ছোট পরিসরে গড়ে উঠা দুগ্ধ খামারগুলো আশেপাশে কিছু দুধ বিক্রি করতে পারলেও বাণিজ্যিকভাবে গড়া খামারগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম জেলায় নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত ডেইরি খামার আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। ডেইরি খামার থেকে প্রতিদিন ৪ লাখ লিটার এবং পারিবারিকভাবে পালন করা গাভী থেকে ৬ লাখ সহ ১০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। শহরে এসব দুধ ৬০-৬৫ টাকা এবং উপজেলা পর্যায়ে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়।
সান নিউজ/আইকে