জাতীয়

বাংলাদেশ-মালদ্বীপের সোনালী সূচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক : মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সোলিহর ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিকতা যোগ করেছে। কেননা দেশটি দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ঢাকার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। শুধু তাই নয়, মাসখানেকের ব্যবধানে মোট ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে ঢাকা-মালে; যার মধ্যে প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে চারটি সম্পন্ন হয়েছে।

ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশটির সঙ্গে এ অঞ্চলের কূটনীতিতে নতুন মাত্রা পাওয়া ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)-এ বাংলাদেশের আদর্শিক চাওয়ার মিল রয়েছে। এ কারণে দেশটি ভাবনায় রয়েছে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার। একই সঙ্গে কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে আকাশপথ ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ বাড়াতে মতৈক্যে পৌঁছেছে দুই দেশ।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সোলিহ। সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে যৌথ কমিশন গঠন (জেসিসি), পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে সহায়তা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়।

এছাড়া দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় উঠে এসেছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, শুল্ক সহযোগিতা ও দ্বৈত কর পরিহার, বিনিয়োগ, অভিবাসী ইস্যু, মানবসম্পদ ও যুব সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ঔষধ সামগ্রী, কৃষি, পর্যটন, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও প্রশমন। আর এসব বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণেও একমত হয়েছেন দুই শীর্ষ নেতা।

বাংলাদেশের জোড়া উদযাপনে অংশ নিতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে ফার্স্ট লেডি ফাজনা আহমেদ ছাড়াও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্ৰী আব্দুল্লাহ শহিদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্ৰীসহ মোট ২৭ জন অতিথি ঢাকায় আসেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের এ সফর দুই দেশের চলমান সু-সম্পর্কে নতুন করে বহুমাত্রিকতা যোগ করেছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও প্রতিবেশী দেশগুলোর যে সমর্থন রয়েছে এটি তারই প্রতিফলন। তারা বলছেন, এ সফরে ভারত মহাসাগরে কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিয়ে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেখানে মালদ্বীপের সমর্থন পাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।

বাংলাদেশের জোড়া উদযাপনে যোগ দিতে বুধবার সকালে ঢাকায় পৌঁছান মোহাম্মদ সোলিহ। সফরের শুরুতেই সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে সম্মান জানান তিনি। বিকেলে ফার্স্ট লেডি ফাজনা আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছান সোলিহ।

জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দশ দিনের আয়োজনের সূচনার দিনে বক্তব্য দিয়েছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর জীবন বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।

বন্ধুর পথ পেরিয়ে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন সোলিহ। তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথাও। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে বাংলাদেশ যে সাহায্য মালদ্বীপকে করেছে, সে কথা তুলে ধরে সোলিহ বলেন, মালদ্বীপ বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্বের জন্য কৃতজ্ঞ। এ বন্ধুত্ব মহামারি সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সাহায্য করছে। এ সহযোগিতা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের একটি নিদর্শন।

সফরের দ্বিতীয় দিনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে দুই নেতা একান্ত বৈঠক করেন। পরে তাদের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে সার্বিক সহযোগিতা জোরদারে একটি যৌথ কমিশন গঠনসহ চারটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ঢাকা-মালের মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি দুই দেশের নেতার নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার বিষয়েও একমত হয়েছে দুই দেশ।

শেখ হাসিনা-সোলিহ বৈঠক শেষে বিকেলে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও আবদুল্লা শহিদ। আব্দুল মোমেন জানান, মালদ্বীপে সরাসরি জাহাজ ও বিমান চলাচলে একমত হয়েছে দুই দেশ। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) সই করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ তাতে সম্মত হয়েছে।

অন্যদিকে আবদুল্লা শহিদ জানান, কানেকটিভিটি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণাকে দেশটি স্বাগত জানিয়েছে। আকাশপথের পাশাপাশি আমরা সমুদ্রপথেও যোগাযোগ বাড়াতে চাই। আমরা দুদেশ ভারত মহাসাগরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করব। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালদ্বীপ বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন শহিদ।

মালদ্বীপ প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে শহিদ জানান, দেশটিতে অবস্থানরত প্রবাসীদের বিনামূল্যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট সোলিহ দুই দেশের অর্থনীতিতে মালদ্বীপে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবদানের প্রশংসা করেন। শেখ হাসিনা মালদ্বীপে অনিয়মিত শ্রমিকদের দ্রুত নিয়মিত করার অনুরোধ করেন।

মাসখানেক আগে মালদ্বীপের সঙ্গে শ্রমবাজার সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি সই করে বাংলাদেশ, যেখানে নতুন করে জনবল নিয়োগ, অবৈধ কর্মীদের বৈধতা দেওয়া ও ফেরানোর প্রক্রিয়া যুক্ত রয়েছে।

বেসরকারি হিসেব বলছে, মালদ্বীপে বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই দেশটির নির্মাণশিল্পে কাজ করছেন। তবে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশটিতে ৮০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সফররত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সোলিহ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানেও আলোচনা হয় কানেকটিভিটি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে।

এদিকে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চলতি বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সভাপতি পদে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের আঞ্চলিক পরিচালক পদে ২০২৩ সালের জন্য বাংলাদেশি প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দেবে মালদ্বীপ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘মালদ্বীপ ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র হলেও ভূ-রাজনৈতিক একটা গুরুত্ব আছে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরে বহুমাত্রিক সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। মালদ্বীপের সঙ্গে আমাদের বরাবরই ভালো সম্পর্ক। এ সম্পর্কটা আরও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে এই সফরে। দুই দেশ যে সমঝোতাগুলো করেছে এগুলো উভয়ের সম্পর্ক শক্তিশালী করার পাশাপাশি এ অঞ্চলে বাংলাদেশের যে একটা ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বাংলাদেশের প্রতি যে সমর্থন আছে সেটার একটা প্রতিফলন দেখতে পাই। আমার মনে হয়, তাদের আগমন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উদযাপনকে গৌরবান্বিত করেছে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক একটা সহযোগিতা বা কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশকে নিয়ে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেখানে মালদ্বীপের সহায়তা একটা নতুন মাত্রা দিবে। সব মিলিয়ে এটি আমাদের কূটনীতির জন্য এবং মালদ্বীপের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কল্যাণে আসবে। মালদ্বীপের অর্থনীতি খুব বড় না কিন্তু এখানে ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা এবং কূটনৈতিক গুরুত্বটা বেশি।’

এদিকে দুই দিনের সফর শেষে রাত ১টায় ঢাকা ছাড়েন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহ ও তার সফরসঙ্গীরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বিমানবন্দরে তাদের বিদায় জানান।

সান নিউজ/এসএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

আজ বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ...

কাতারের সঙ্গে ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই 

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ও কাতা...

চরাঞ্চলে তরমুজের বাম্পার ফলন

গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধার চ...

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

হেলিকপ্টার সংঘর্ষে নিহত ১০

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মালয়েশিয়ান ন...

খাগড়াছড়িতে গৃহকর্মীকে জিম্মির অভিযোগ 

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিঃ

যোদ্ধা প্রত্যাহার করল মিয়ানমার গোষ্ঠী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল জান্তা সৈন্যদের স...

তাপপ্রবাহ কমে গেলে লোডশেডিং থাকবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক : তাপপ্রবাহ কমে...

স্বর্ণের দাম আরও কমলো

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি মাসে ৩ দফ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা