শিল্প ও সাহিত্য

শহীদুল্লাহ কায়সারের জন্মদিন আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি, শহীদ বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক, লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের জন্মদিন। কেবল সাহিত্য নয়, সাংবাদিকতা ও দেশের প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিতেও তার অবদান রয়েছে। রাজনীতির জন্য বেশ কয়েকবার কারাগারেও যেতে হয়েছে তাকে। তার অনেক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ও নাটক। তার সেরা কাজ সংসপ্তক উপন্যাস যেখানে তিনি দেশের বিভিন্ন সময়কে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার।

প্রাথমিক কর্মজীবন : ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মাজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শহীদুল্লাহ কায়সার। তার বাবার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। এই দম্পত্তির আট ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

শিক্ষাজীবনের শুরুতে সরকারি মডেল স্কুল এবং পরে 'মাদরাসা-ই-আলিয়ার এ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন কলকতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৬ সালে তিনি এখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু এখানকার পড়া শেষ করতে পারেননি তিনি। একই সাথে তিনি রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইন নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। কিন্তু দেশ বিভাগের কারণে এই পড়াও শেষ করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাবার সাথে ঢাকায় চলে আসেন শহীদুল্লাহ। এখানে এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ক্লাসে। তবে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে মাস্টার্স শেষ করার আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন।

রাজনীতিতে অবদান : ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার। রাজনীতির কারণে একাধিকবার কারাগারেও যেতে হয়েছে তাকে। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ও ১৯৫১ সালে পার্টির সদস্য হন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন। পাশাপাশি দেশপ্রেমিক ও বিশ্বকর্মা ইত্যাদি ছদ্মনামে ছদ্মনামে পত্রিকায় দেশের নানা সমস্যা নিয়ে কলাম লেখাও চলতে থাকে।

১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রাখার কারণে পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূল হন শহীদুল্লাহ কায়সার। যার ফলে ১৯৫২ সালের ৩ জুন প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন তিনি। তখন দীর্ঘ তিন বছর অন্তরীণ ছিলেন এই নেতা। ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরেই ফের আটক হন শহীদুল্লাহ। কয়েক বছর পর মুক্তি পান। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয়৷ জননিরাপত্তা আইনে এই দফায় তাকে প্রায় ৪ বছর আটকে রাখার পর ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে ছাড়া পান তিনি।

সাংবাদিকতায় অবদান : সাংবাদিকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন শহীদুল্লাহ কায়সার। তিনি ১৯৪৯ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিচালিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ তিনি। এ বছরের অক্টোবরে গ্রেফতার হন। ১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়ে পুনরায় দৈনিক সংবাদে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু এ পত্রিকা সাথেই জড়িত ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, প্রবন্ধকার, গবেষক, প্রকাশক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক তার এক প্রবন্ধে শহীদুল্লা কায়সার সম্পর্কে বলেন, তাকে যখন চিনতাম তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক, কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা। কোন অনুষ্ঠানে সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথি হিসেবে, রাজপথে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পুরোভাগে দেখেছি। ওনার সামনে সরাসরি যাবার বা কথা বলার যোগ্যতা বোধকরি তখন আমাদের ছিলনা। আমরা দ্বিধায় ভুগতাম। যদিও আমি জড়িত ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই। আমরা মোহিত ছিলাম ওনার ব্যক্তিত্ব আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে।’এতটাই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন এই লেখক।

সাহিত্যে অবদান : প্রগলিশীল দলের রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হতো। পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাতেও যথেষ্ট সময় দিতে হতো তাকে। তারপরও লেখালেখি করেছেন প্রচুর। ভাবলে অবাক হতে হয় এতসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যেও কীভাবে এতসব মানসম্পন্ন লেখা লিখেছেন এই সাহিত্যিক। তবে কেবল লেখক হওয়ার জন্য লেখালেখি করেননি শহীদুল্লাহ কায়সার। লেখালেখি ছিল তার মিশন যে কারণে সংশংপ্তক ও সারেং বউয়ের মতো উপন্যাস রচনা করতে পেরেছেন এই সাহিত্যিক।

তার উপন্যাসের মধ্যে- সংশপ্তক, সারেং বউ, কৃষ্ণচূড়া মেঘ, তিমির বলয়, দিগন্তে ফুলের আগুন, সমুদ্র ও তৃষ্ণা, চন্দ্রভানের কন্যা, কবে পোহাবে বিভাবরী (অসমাপ্ত) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রাজবন্দীর রোজনামচা (১৯৬২) ও পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ (১৯৬৬) নামে তিনি দুটি স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী রচনা করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের সেরা সৃষ্টি সংশপ্তক : শহীদুল্লাহ কায়সারের সেরা সাহিত্যকর্ম সংশপ্তক উপন্যাস। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যে এটি শহীদুল্লাহ কায়সারের এক অমর কীর্তিগাথা যার আভিধানিক অর্থ- হয় জয় না হয় মৃত্যু। রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত এদেশের হিন্দু- মুসলমানের সম্মিলিত জীবন নিয়ে এবং অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সার্থক সৃষ্টি সংশপ্তক, যা প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। বিশাল কলেবরে রচিত এই উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভাষা আন্দোলনের সুবিশাল প্রেক্ষাপট। গ্রন্থখানিতে আছে মহাকাব্যিক ব্যপ্তি, আছে প্রসারতা। সংশপ্তক উপন্যাসের দীর্ঘ আয়তনে ধরা পড়েছে বহু চরিত্র- সকলের উপর জাগ্রত পুরুষ-শাসিত মুসলিম সমাজে নারীর অধিকারবোধ নিয়ে জেগে ওঠার আকুতি।

উপন্যাসের নায়ক জাহেদ একজন বিপ্লবী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষাপ্রাপ্ত টগবগে যুবক। মানুষ মাত্রই তার ভালবাসার পাত্র। আসলে জহেদ চরিত্রটি লেখকেরই প্রতিচ্ছায়া। স্কুল মাস্টার সেকান্দর, পতিতা হুরমতি, চাষী লেকু- সবাই তার স্নেহ ও ভালবাসা পায়। জাহেদ মানুষের প্রতি আশাবাদী, আশাবাদী তার জীবনের প্রতি। চরম বিপদের সময়েও তার বিপ্লবী সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। এই উপন্যাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র রাবু। সে বিবাহিতা হওয়া সত্ত্বেও অতীতকে অস্বীকার করে বিপ্লবী জাহেদের সঙ্গে সমাজ সেবায় ব্রতী হয়। জাহেদকে ভালবাসে সে। একই সঙ্গে জাহেদের রাজনৈতিক মুক্তি পথের সাথী রাবু। সেকান্দর মাস্টারও দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের একজন নিবেদিত কর্মী।

সমগ্র উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে বাকুলিয়া ও তালতলি গ্রাম দুটিকে কেন্দ্রে করে। এখান থেকে ঘটনা কলকাতা, ঢাকা পরিক্রম করেছে। জাহেদ, রাবু, ফেলু, মালু, রমজান, সেকান্দর মাস্টার, হুরমতি, লেকু- এদের চরিত্র-চিত্রণে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে। এই চরিত্রগুলোর গল্পের শেষ নেই। তালতলির গল্প, বাকুলিয়ার গল্প, যুদ্ধের গল্প, দুর্ভিক্ষের গল্প, দাঙ্গার গল্প, ইংরেজ চলে যাবার গল্প, রমজানের মতো যেসব সুযোগসন্ধানী ফায়দা লুটতে চায় তাদের গল্প, ভিটেহারাদের গল্প। এইসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক তুলে ধরেছেন এই দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের গল্প। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ‘সংশপ্তক’বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু গ্রামীণ জীবনের সামন্ত প্রভূদের অত্যাচার আর তার মধ্য থেকে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক মনোজ্ঞ পাঁচালি। এজন্যই তো এর নাম সংশপ্তক-নিশ্চিত পরাজয় জেনেও আমৃত্যু লড়াই করে চলেছে যে বীর। জীবনের শেষ আছে কিন্তু এ লড়াইয়ের শেষ নাই। শেষ নেই সংশপ্তকেরও-যতদিন বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবে এ উপন্যাসটি।

পুরস্কার সম্মাননা : শহীদুল্লাহ কায়সার তার সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসাবে জীবিত থাকতেই পেয়েছেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২) ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এছাড়া ১৯৮৩ সালে সাংবাদিকতায় মরণোত্তর একুশে পদক এবং সাহিত্যে অববদানের জন্য ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার।

ব্যক্তিগত জীবন : শহীদুল্লাহ কায়সার ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পান্না কায়সারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির শমী কায়সার ও অমিতাভ কায়সার নামে দুইজন সন্তান রয়েছে। পান্না কায়সার নিজেও একজন লেখক। পেশাজীবনে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসাবে তিনি সংসদ সদস্য (১৯৯৬ – ২০০১) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া শহীদুল্লাহ কায়সারের ভাই জহির রায়হান ছিলেন দেশের একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক।

মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তাকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। পরে তার খোঁজে গিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি চিরতরে নিখোঁজ হন তার ছোট ভাই জহির রায়হানও।

আজ এই বরেণ্য সাহিত্যিকের ৯৫তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন সংশপ্তক উপন্যাসের রচয়িতা শহীদুল্লাহ কায়সার।

সান নিউজ/ওমেন্স নিউজ/এসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ফেনসিডিলসহ ২ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি: মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার বৈ...

কেশবপুরে ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত 

আব্দুর রাজ্জাক সরদার, কেশবপুর প্রতিনিধ:

ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩

মোঃ মনির হোসেন স্টাফ রিপোর্টার :...

জাহাজ উদ্ধারে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মন্তব্য ক...

আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত

স্পোর্টস ডেস্ক : বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এল...

নিগৃহীত নেতাদের তালিকা দিতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: আ’লীগের স...

গণপিটুনিতে ২ জনের মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি: গাজীপুর জেলার কাপ...

মাংসের বাজারে মিলছে না স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রোজার শুরু থেকেই গরু, মুরগি, খাসিসহ সব ধরন...

কুকুরের কামড়ে শিশুসহ আহত ৮

জেলা প্রতিনিধি: নাটোর জেলার লালপু...

লরি-কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষ, নিহত ১

জেলা প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলে লরি ও কাভার্ডভ্যানের মুখোমুখি সংঘর...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা