সারাদেশ

রাঙামাটির দেড় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে সংশয়

এম. কামাল উদ্দিন : রাঙামাটি জেলার দেড় শতাধিক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারি কাটিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো চালুর প্রস্তুতি শেষ করলেও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর কোন প্রস্তুতিই নেই। বিপরীতে অনেক বিদ্যালয় চালুই হবে না।

শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বিদ্যালয়গুলো চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে শিক্ষার্জন থেকে বঞ্চিত হবে হাজার শিশু। এ আশংকার কথা স্বীকারও করছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। এমন ধরণের বিদ্যালয়ের সংখ্যা রাঙামাটি জেলার বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বাঘাইছড়ি উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশী। জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও এ ধরণের বিদ্যালয় রয়েছে।

মুলত করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অর্থ সংকটে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ কথা স্বীকার করেছেন। বরকল উপজেলার বড় হরিণা ইউনিয়নের সদস্য কিরণ জ্যোতি চাকমা বলেন, ইউনিয়নটি দুর্গম ইউনিয়ন।

এখানে মানুষ কোন রকম খেয়ে বেঁচে আছে। বছরের পর বছর বিদ্যালয় চালানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এমন অবস্থায় করোনা ভাইরাস এসে গেল। এর কারণে এলাকায় অর্থনৈতিক অবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এদিকে শিশুরা গত এক বছর শিক্ষক বিহীন অবস্থায় থাকায় পড়াশুনার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে।এ সংখ্যা হাজার অধিক হবে বলছেন স্থানীয়রা।

বরকলের ভুষণছড়া ইউনিয়নে তাগলক বাগ এলাকার স্নেহ রঞ্জন চাকমা (৪০) বলেন, ৪টি গ্রাম নিয়ে তাগলক বাগ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মাণ করা হয়। এ বিদ্যালয়ের শিশুরা বিগত একটি বছর কোনও পড়ালেখা করতে পারেনি। এলাকায় চরম আর্থিক সংকট দেখা দেওয়ায় শিক্ষকদের বেতন দিতে না পারায় শিক্ষকরা বিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছে।

এলাকায় বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট না থাকায় অনলাইন ক্লাশ কি তারা জানেন না। সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বই দেওয়া হলেও তাগলক বাগ স্কুলে কোন বই আসেনি। এখন ছেলেমেয়েরা জুমে, বাগানে, কেউ মাছ শিকারে যায় বলেন স্নেহ রঞ্জন চাকমা।

একই গ্রামের চিত্র সেন চাকমা (৬৫) বলেন, ‘এলাকা মানুষের প্রধান আয় আসে সেগুন বাগান বিক্রি করে। কিন্তু সেটিও বন্ধ। হলুদ চাষে কিছু আয় আসে। এ বছর ফলন কম এবং বাজারে দাম না থাকায় এসব বিক্রি করে কোনও রকম জীবন নিত্যদিনের বাজার খরচ হচ্ছে।’

সর্বশেষ জাতীয়করণের তালিকায় দুর্গম এসব এলাকার বিদ্যালয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। করোনাকালীন সময়ে কোনও সহযোগীতা পায়নি এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। একদিকে বেতনহীন জীবন, অন্যদিকে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় এসব এলাকায় অধিকাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যালয় ছেড়ে অন্য পেশা বেচে নিয়েছে।

বর্তমানে যেসব শিক্ষক বিদ্যালয় আঁকড়ে পড়ে আছেন তাদের মাঝে বিরাজ করছে হাতাশা। এ হতাশা থেকে অনেকে বিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছেন। অন্যরা চলে যাবার কথা ভাবছেন। বামে ভুষণছড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কাঞ্চনা চাকমা বলেন, বিগত একটি বছর বেতন ছাড়া দিন কেটেছে আমাদের। এলাকায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ায় কোনও অবিভাবক আমাদের বেতন দিতে পারেনি। সর্বশেষ জাতীয়করণের তালিকায় আমাদের বিদ্যালয়টি স্থান পায়নি। এখন ভবিষ্যত অন্ধকার দেখি। স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাবে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উষা রায় চাকমা বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ৬৬ জন শিক্ষার্থী আছে। বিদ্যালয়টি খোলা নিয়ে কোনও প্রস্তুতি নেই। আমাদের এখনও বই দেওয়া হয়নি। অথচ পার্শবর্তী সরকারি সব স্কুলে বই দেওয়া হয়েছে। উষা রায় বলেন, এর আগে টঙ্যা এনজিও মাসিক কিছু বেতন দিত। এটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি। বর্তমান যে অবস্থা এ পেশায় থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে বিভিন্ন সময়ে এসব বিদ্যালয়গুলো নির্মাণ করেছিল সরকার। কিন্তু সরকারিভাবে বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন প্রদানের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। এতদিন গ্রামবাসীর গণচাঁদা ও কিছু এনজিওর তহবিলে চলছিল বিদ্যালয়গুলো। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সবকিছু পাল্টে যায়।

জুরাছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কৌশিক চাকমা বলেন, সরকারি নির্দেশনার পরপরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলবে। এজন্য বিদ্যালয় প্রতি অর্থ বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। এ বিদ্যালয়গুলো এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু বেসরকারিগুলো কোনও অর্থ বরাদ্ধ পায়নি। এসব অনেক বিদ্যালয় অঙ্গন ঝোঁপঝাড়ে পরিণত হয়েছে। এগুলো আদৌ চালু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক সম্পর্কে অনেকে অবগত নয়। এটি সমতল অঞ্চলের মত নয়। কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনেকে পাহাড়কে সমতলের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। ফলে পাহাড়ের সমস্যা থেকেই যায়।

এখানে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রয়োজন। প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো চালিয়ে নিতে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। যেগুলো জাতীয়করণ হয়নি এগুলো জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। না হলে বিপুল পরিমান জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে তারা রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, সর্বশেষ জাতীয়করণ হবার পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল সবগুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষাপটে তা সত্য নয়। পাহাড়ে অনেক জাতীয়করণের সব শর্ত পুরণ করলেও বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়েছে। শুধু রাঙামাটি নয় তিন পার্বত্য জেলায় বাদ পড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো চিহ্নিত করে এগুলো চালিয়ে নিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

যতদিন এগুলো জাতীয়করণ করা না হয় ততদিন এগুলো চালু রাখতে পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য মন্ত্রণালয় বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে এনজিওদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

দেবাশীষ রায় আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের এমনও এলাকা রয়ে গেছে যেখানে এখনও বিদ্যুৎ নেই। ইন্টারনেট নেই। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্দেশনা অনলাইনে প্রেরণ করা হচ্ছে কিন্তু দুর্গম এসব এলাকা বিদ্যালয়গুলো এসব সরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা পায় না। করোনাকালীন সময়ে অনলাইন ক্লাশ কি এসব এলাকার শিক্ষক শিক্ষার্থীরা কেউই কিছু জানে না।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির আলোকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগটি জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাঙামাটি জেলা পরিষদের তথ্যমতে সর্বশেষ ৩য় ধাপে ৭৯টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ ৭৯ টি ছাড়াও আরও প্রায় ৩০টির অধিক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তালিকাভুক্ত হয়নি।

রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সমন্বয়ক প্রিয়নন্দ চাকমা বলেন, বিদ্যালয়গুলো চালু নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টি ঠিক। বিদ্যালয়গুলো অনিমিয়ত হয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ হল বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন পায় না। এসব অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বেতন চেয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে আবেদনপত্র দিয়েছেন।

এ সমস্যার বিষয়গুলো নিয়ে জেলা পরিষদ অবগত আছে। তবে বিদ্যালয়গুলো নিয়ে জেলা পরিষদ এখনও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। এগুলো চালু রাখতে হলে সরকারের বিশেষ সুদৃষ্টি প্রয়োজন।

রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এ বিষয়টি তিনি অবগত ছিলেন না। যদি সত্য হয়ে থাকে তবে এটি এসডিজি লক্ষ্য পুরণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ সমস্যা নিয়ে এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতগুলো শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে এটা রাষ্ট্র কামনা করে না। উপজেলা ভিত্তিক এসমস্ত বিদ্যালয়গুলোর পুর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নজরে আনা হবে।

সান নিউজ/কামাল/এসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ভোলায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত 

ভোলা প্রতিনিধি: তীব্র তাপদাহ থেকে...

আড়িয়ল ইউপিতে উপ-নির্বাচন

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

খাগড়াছড়িতে গৃহকর্মীকে জিম্মির অভিযোগ 

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিঃ

কার্বণ মিল ও সীসা কারখানা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী প্রতিনিধি:

অনির্দিষ্টকালের জন্য চুয়েট বন্ধ ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাস চাপায় চুয়েট...

রাজধানীতে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর শাঁখা...

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়ছে না ছুটি

নিজস্ব প্রতিবেদক : আবহাওয়া অধিদপ্...

আবারও কমলো স্বর্ণের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি মাসে তিন...

রংপুরে বৃষ্টির জন্য ইস্তিসকার নামাজ আদায়

রংপুর প্রতিনিধি : সারাদেশের মতো র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা